দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে বক চয়, জানুন পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
![বক চয় বক চয়](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2025/02/07/freshpoint-cabbage-bok-choy_0.jpg)
বক চয় একটি জলজ ও আধা-জলজ সবজি বা শাক যা মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয়। এটিকে চাইনিজ বাঁধাকপিও বলা হয়। এটি শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয় বিশেষত ভাজি, ভর্তা, কিংবা স্যুপে ব্যবহার করা হয়। বক চয় কেবল সুস্বাদুই নয়, বরং এটি স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী যেটি আমরা অনেকেই জানি না।
চলুন জেনে নিই বক চয়ের উপকারিতা। এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সিনিয়র পুষ্টিবিদ শরীফা আক্তার শাম্মী।
বক চয় একটি অত্যন্ত উপকারী সবজি যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাহায্য করে। এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। নিয়মিত বক চয় খেলে সুস্থ ও শক্তিশালী থাকা যায়। তাই আমাদের খাদ্যতালিকায় বক চয় যোগ করা উচিত। এটি আমাদের শরীরে বিভিন্নভাবে উপকার করে, যার মধ্যে হজমশক্তি বৃদ্ধি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তস্বল্পতা দূর করা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বক চয়ের পুষ্টি উপাদান
১০০ গ্রাম বকচয় থেকে পাওয়া যায়-
ক্যালরি: ১৩ ক্যালোরি
প্রোটিন: ১.৫ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট: ২.২ গ্রাম
আঁশ: ১.০ গ্রাম
ফ্যাট: ০.২ গ্রাম
ভিটামিন এ: দৈনিক প্রয়োজনের ৮৯% (বিটা-ক্যারোটিন থেকে)
ভিটামিন সি: দৈনিক প্রয়োজনের ৭৫%
ভিটামিন কে: দৈনিক প্রয়োজনের ৫৭%
ফোলেট (ভিটামিন বি৯): ১৬%
ক্যালসিয়াম: ১০৫ মিগ্রা
আয়রন: ০.৮ মিগ্রা
পটাসিয়াম: ২৫২ মিগ্রা
ম্যাগনেসিয়াম: ১৯ মিগ্রা
বক চয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি কম ক্যালরিযুক্ত হওয়ায় ওজন নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর।
বকচয়ের উপকারিতা
পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবজি
বক চয় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ।
ভিটামিন এ: চোখের জন্য উপকারী, রাতকানা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ভিটামিন সি: রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বকের জন্য ভালো।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স: শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে।
ক্যালসিয়াম: হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়তা করে।
লোহা: রক্তস্বল্পতা দূর করে।
ফাইবার: হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
বক চয়ে উপস্থিত উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং ঠান্ডা, কাশি, জ্বর ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে।
হজমশক্তি উন্নত করে
বক চয়ে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক। এটি অন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয় এবং পেটের সমস্যা যেমন গ্যাস, বদহজম, পেট ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে।
রক্তস্বল্পতা দূর করে
বক চয়ে উচ্চমাত্রার আয়রন (লোহা) রয়েছে, যা লোহিত রক্তকণিকার গঠনে সহায়ক। এটি রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষত, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুর জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
গবেষণায় দেখা গেছে, বক চয় রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ইনসুলিনের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো ফল দিতে পারে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
বক চয় হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে কারণ এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফাইবার হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে এবং উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক
বক চয়ে থাকা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান যেমন বিটা-ক্যারোটিন, লুটেইন এবং ক্লোরোফিল দেহের ক্ষতিকর ফ্রি-র্যাডিক্যাল দূর করে, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটি কোলন ক্যানসারসহ বিভিন্ন প্রকার ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে পারে।
ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী
বক চয়ে প্রচুর ভিটামিন এ, সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বককে উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর রাখে। এটি ব্রণ দূর করতে সাহায্য করে এবং ত্বকের বয়সের ছাপ কমাতে কার্যকর। পাশাপাশি, চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং চুল পড়া কমায়।
চোখের জন্য উপকারী
বক চয়ে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে, যা চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। এটি রাতকানা প্রতিরোধ করে এবং চোখের অন্যান্য সমস্যা দূর করে।
স্ট্রেস ও মানসিক চাপ কমায়
বক চয়ে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়াম ও বি ভিটামিন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, স্নায়ুকে শিথিল করে এবং অনিদ্রা দূর করতে সহায়ক।
লিভারের জন্য ভালো
বক চয় লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং লিভারের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি লিভারের ডিটক্সিফিকেশন (বিষমুক্তকরণ) প্রক্রিয়া উন্নত করে।
কিডনির জন্য উপকারী
বক চয় প্রাকৃতিক ডাইউরেটিক হিসেবে কাজ করে, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত লবণ ও বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সহায়তা করে। এটি কিডনি সুস্থ রাখতে এবং কিডনির পাথর প্রতিরোধে সাহায্য করে।
হাড় ও দাঁতের জন্য ভালো
বক চয়ে প্রচুর ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে, যা হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং অস্টিওপরোসিস (হাড় ক্ষয়) প্রতিরোধে সহায়তা করে।
অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য উপকারী
গর্ভাবস্থায় বক চয় খাওয়া উপকারী কারণ এটি আয়রন, ফোলেট এবং ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ। এটি শিশুর সঠিক বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং মায়ের পুষ্টিগত চাহিদা পূরণ করে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
বক চয়ে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকায় এটি ওজন কমাতে সহায়ক। এতে থাকা ফাইবার দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে এবং অতিরিক্ত খাবারের প্রবণতা কমায়।
প্রদাহ দূর করতে সহায়ক
বক চয় বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস, জয়েন্ট পেইন ও অন্যান্য প্রদাহজনিত সমস্যায় এটি উপকারী।
ইনফেকশন ও ক্ষত সারাতে সাহায্য করে
বক চয়ে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিসেপটিক উপাদান ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি ক্ষত দ্রুত শুকাতে সহায়ক।
বক চয় সহজলভ্য এবং রান্না করাও সহজ। এটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করা যায়—ভাজা, ভাপানো, কিংবা স্যুপ ও কারিতে ব্যবহার করা যায়।
সতর্কতা
বক চয় সাধারণত স্বাস্থ্যকর সবজি হলেও কিছু সতর্কতা মেনে চলা উচিত।
অতিরিক্ত গ্রহণ এড়ানো: বক চয়ে গোয়াইট্রোজেন নামক যৌগ থাকে, যা অতিরিক্ত খেলে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে বাধা দিতে পারে, বিশেষ করে যদি কাঁচা খাওয়া হয়।
রক্ত পাতলা হওয়ার ঝুঁকি: এতে উচ্চমাত্রার ভিটামিন কে আছে, যা রক্ত জমাট বাঁধার ওষুধ (যেমন: ওয়ারফারিন) গ্রহণকারীদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
অ্যালার্জির ঝুঁকি: সংবেদনশীল ব্যক্তিদের জন্য এটি অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। তাই প্রথমবার খাওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে।
অতিরিক্ত আঁশজনিত সমস্যা: বেশি পরিমাণে বক চয় খেলে হজমে সমস্যা, গ্যাস বা পেট ফাঁপার সমস্যা হতে পারে।
Comments