অটিজমের লক্ষণ কী, কোন বয়সে শিশুর কোন আচরণ দেখলে সতর্ক হবেন

ছবি: সংগৃহীত

জন্মের পর শিশুর শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশে যত্ন নেওয়া কতটা জরুরি জানেন কি? অযত্ন আর অবহেলায় কিংবা খামখেয়ালিতে শিশুর সমস্যা চিহ্নিত করতে দেরি করছেন না তো?

আপনার শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কি না কীভাবে বুঝবেন তা জেনে নিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অটিজম অ্যান্ড এনডিডি সেলের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডুর কাছ থেকে।  

অটিজম কী ও লক্ষণ

অটিজম শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা।

ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, 'একটি শিশুর জন্মের ৩ বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথম ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত এটা বোঝা যায় না। ১৮ মাসের পর থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যে একটা শিশুর মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন-

১. শিশু অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা করতে চায় না।

২. নিজের মতো করে চলতে চায়।

৩. এই শিশুরা মায়ের সঙ্গে বা অন্যদের সঙ্গে হয় কথাবার্তা বলে না প্রথম থেকে, অথবা বললেও ১৮ মাস বয়সে এসে কথা বলা কমে যেতে থাকে।

৪. অন্যের সঙ্গে কথা কমে যাওয়ার পাশাপাশি নিজে নিজে কথা বলা শুরু করে শিশুটি।

ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, 'কথাবার্তা বলার অর্থ একজন বলবে আরেকজন শুনবে, আবার আরেকজন বলবে এই রকম। কিন্তু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে এই ধরনের কথাবার্তা থাকে না।'

সামাজিক মেলামেশা এবং কথাবার্তার পাশাপাশি আরও একটি অসুবিধা হয়। সেটি হচ্ছে আচরণগত পরিবর্তন। যেমন-

১. একই কাজ বারবার করতে থাকা।

২. একই খেলা বারবার খেলা।

৩. একইভাবে কিছু অঙ্গভঙ্গি করা।

৪. কিছু নির্দিষ্ট জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।

৫. নির্দিষ্ট জামাকাপড় ছাড়া পরতে চায় না।

৬. খাবার খেতে চায় না নির্দিষ্ট পছন্দের বাইরে।

অর্থাৎ পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণের প্রবণতা দেখা যায়।

আর একই কাজ করার প্রবণতা থেকে যদি সরানো হয় তখন শিশুটি আক্রমণাত্মক হয়ে যায়।

আচরণগত অসুবিধা, কথাবার্তার অসুবিধা ও সামাজিক মেলামেশা, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা না করার প্রবণতা এই ৩টি জিনিস যখন থাকে একটি ৩ বছরের শিশুর মধ্যে, তখন সে অটিজমের বৈশিষ্ট্য বহন করছে বলে মনে করা হয় বলে জানান ডা. গোপেন কুন্ডু।

অটিজমের কারণ

ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, অটিজমের কারণ কী তা জানতে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও এটা বোঝা গেছে যে, অটিজম জিনগত সমস্যা ও পরিবেশগত সমস্যা থেকে হয়।

জিনগত অসুবিধা

বাচ্চা যখন ভ্রুণ অবস্থায় থাকে তখন থেকেই এই জিনের অসুবিধা নিয়ে আসে। তবে দেড় বছরের আগে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায় না। এই অসুবিধা জন্ম থেকেই নিয়ে আসে বাচ্চা।

আবার সবার মধ্যে অসুবিধাগুলো প্রকাশ পাবে এমনটিও নয়, কারো মধ্যে অসুবিধা বেশি প্রকাশ পায় কারো মধ্যে কম। এর কারণ হচ্ছে পরিবেশগত অসুবিধা।

পরিবেশগত অসুবিধা

কোন পরিবেশে শিশুটি বড় হচ্ছে এবং তার জিনগত অসুবিধাগুলো প্রকাশ পাবে কতটুকু এটা নির্ভর করে পরিবেশের ওপর।

ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজম গ্রামীণ এলাকায় কম, শহরে বেশি। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে অটিজম বেশি ও প্রান্তিক এলাকায় কম। ঢাকা শহরে অটিজমের সংখ্যা ১০০ জনে ৩ জন, প্রান্তিক এলাকায় ৭০০ জনে ১ জন শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।'

এর কারণ হিসেবে ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, 'ঢাকা শহরের বাচ্চারা ঘরের মধ্যেই বেশিরভাগ সময় বাবা-মা নিয়ে ছোট পরিবারে থাকে। গ্রামে পুরো পরিবার নিয়ে থাকে শিশুরা, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়। ঢাকা শহরে এটা কম। ঢাকা শহরের বাতাসে হেভি মেটাল থাকে, লেড থাকে, আয়রন থাকে। গ্রামের বাতাসে এগুলো কম থাকে এটা প্রমাণিত। ঢাকা শহরের বাচ্চারা মোবাইল ও ফাস্টফুডে আসক্ত, প্রিজারভেটিভযুক্ত খাবার খায়। গ্রামে এসব কম।'

তিনি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে ছেলে শিশুদের মধ্যে অটিজম বেশি, মেয়ে শিশুদের মধ্যে কম।

শিশুর কোন বয়সে কোন আচরণ দেখলে অটিজম বিষয়ে সচেতন হতে হবে

ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, ৬ মাস বয়স থেকেই একটি শিশু কথা বলা শুরু করে। বাবলিং সাউন্ড যেমন- বাবা, মা, দাদা। ১ বছর বয়সে মা-বাবাকে আইডেন্টিফাই করে পরিচিত শব্দ করে। ২ বছরের মধ্যে একটি শিশু ছোট ছোট ২টি শব্দ একসঙ্গে করে বাক্য তৈরি করতে পারে। যেমন- আমি খাব, আমি যাব এগুলো বলতে পারে।

যদি ১ বছরের মধ্যে শিশু বাবা-মা বলতে না পারে অথবা ২ বছরের মধ্যে ছোট শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন করতে না পারে এবং কোনো কারণে তার মধ্যে যদি আচরণের কোনো অসুবিধা যেমন- কারণ ছাড়াই আগ্রাসী আচরণ, কারণ ছাড়াই মায়ের সঙ্গে কান্নাকাটি করা, অন্য শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা না করা ইত্যাদি আচরণ দেখা দেয় তখন বুঝতে হবে শিশুটি অটিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করছে।

এ ছাড়া, ২ বছরের কোনো শিশু কানে শুনতে পেলেও যদি ডাক দিলে সাড়া না দেয়, চোখে যদি চোখ না রাখে, বাবা-মা-দাদার মতো শব্দ না বলে এবং কোনো শিশু ১৮ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে যে কথা বলা শুরু করেছিল সেগুলো যদি হারিয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে এগুলো অটিজমের বৈশিষ্ট্য।

অটিজমের চিকিৎসা

ডা. গোপেন কুন্ডু বলেন, অটিজম শনাক্ত করার জন্য অনেক বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না, কিছু ব্যবহারিক পরিক্ষা করেই বোঝা যায় শিশুটি অটিজমের কিছু সমস্যা বহন করছে কি না। তবে ৩ বছরের আগে অটিজম পুরোপুরি শনাক্ত করা যায় না। ৩ বছরের মধ্যে অটিজমের সবগুলো বৈশিষ্ট্য চলে আসে। ২ বছরের মধ্যে প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য দেখে ৩ বছরের মধ্যে রোগটা শনাক্ত করা হয় জানান এই চিকিৎসক।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসায় অনেক বেশি ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। যেহেতু শিশু কথা বলে না, তাকে স্পিচ থেরাপি দেওয়া হয়। যেহেতু আচরণের পরিবর্তন হয় তাই ব্যবহারিক কিছু ব্যায়াম শেখানোর চেষ্টা করা হয়। অটিজমের সঙ্গে শিশু যদি অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়, শিশুর যদি খিঁচুনি থাকে, ঘুমের সমস্যা থাকে তাহলে সেই শিশুর ক্ষেত্রে কখনো কখনো কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয় বলে জানান ডা. গোপেন কুন্ডু। এই ওষুধগুলো ব্যবহার করলে ওই সমস্যাগুলো দূর হলে অটিজমের মাত্রা কমে যায়।

কোথায় অটিজমের চিকিৎসা পাবেন

২ বছরের মধ্যে ডাক দিলে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রাখে না, কথাবার্তা কম বলছে, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করছে না অথবা আগে কথা বলত এখন কমে গেছে এই অবস্থা যদি দেখেন, তবে অবশ্যই একজন শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

এ ছাড়া শিশু নিউরোলজিস্ট বা শিশু মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন ডা. গোপেন কুন্ডু।

অটিজম শনাক্ত, ব্যবস্থাপনা, প্রিভেনশন এবং নরমাল ডেভেলপমেন্টের জন্য জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে ৩৪টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে চিকিৎসা নিতে পারবেন।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্সটিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) নামে একটি সেন্টার রয়েছে। সেখানেও চিকিৎসা নেওয়া যাবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের (এনআইএমএইচ) সাইক্রিয়াটিস্ট বিভাগে অটিজম চিকিৎসা দেওয়া হয়।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের সঙ্গে সবার ইতিবাচক আচরণ করতে হবে। অটিজম একবারে ভালো হয় না, এটি সারাজীবন চলবে। অটিজমের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যায় প্রথম ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে। ৫ বছরের পরে অনেক বেশি পরিবর্তন হয় না। তাই অটিজমের অসুবিধাগুলো সঠিক সময়ে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারলে  অনেকাংশেই  অটিজমের বৈশিষ্ট্য কমানো যেতে পারে জানান ডা. গোপেন কুন্ডু।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

8h ago