যক্ষ্মার ঝুঁকিতে সিলেট অঞ্চলের শিশুরা

দেশের সিলেট অঞ্চলের জন্য প্রধান স্বাস্থ্য উদ্বেগের বিষয় যক্ষ্মা, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে প্রকোপ বেশি দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের দেওয়া উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান হলো, সাধারণত চা বাগানে বসবাসরত মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। এজন্য এই অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অপুষ্টির হার অনেকাংশে দায়ী।
পরিসংখ্যান বলছে, সিলেটে শিশুদের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়েছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সিলেট বিভাগীয় অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নতুন শিশু আক্রান্তের হার তিন দশমিক নয় আট শতাংশ, ২০২২ সালে পাঁচ দশমিক এক পাঁচ শতাংশ, ২০২৩ সালে সাত শতাংশ এবং ২০২৪ সালে আট দশমিক ছয় ছয় শতাংশ।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, 'চা বাগানে বসবাসকারী অনেকে এখনো নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বের হতে পারছেন না। যেমন—অতিরিক্ত ভিড়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, মাদকাসক্তি, প্রয়োজনীয় খাবারের অভাব, কিছু ক্ষেত্রে একই বাড়িতে গবাদি পশুর সঙ্গে বসবাস। তাছাড়া, বেশিরভাগ চা শ্রমিক সচেতন নন। আবার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব আছে। এসব কারণে তাদের যক্ষ্মার ঝুঁকি বেশি। চা শ্রমিকরা একই ঘরে পাঁচ থেকে আট জন থাকার কারণে যক্ষ্মার জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।'
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, 'চা বাগানের অনেক বাসিন্দা অপুষ্টিতে ভোগেন। এ কারণে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় চা বাগানের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। বর্তমানে চা বাগানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, সন্দেহভাজন রোগীদের থুতু সংগ্রহ করে পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে।'
হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রত্নদ্বীপ বিশ্বাস বলেন, 'যক্ষ্মার লক্ষণ হলো দীর্ঘস্থায়ী কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, ওজন হ্রাস, জ্বর ও রাতের ঘাম। যদি কারো এই লক্ষণগুলো থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। চা শ্রমিকদের বসবাসের পরিবেশ নিম্নমানের। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে তারা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে না। ফলে, এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষ্মা রোগের প্রকোপ অনেক বেশি।'
মৌলভীবাজার জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান বলেন, 'সপ্তাহে পাঁচ দিন এক্স-রে মেশিনের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। মৌলভীবাজারে শিশুদের মধ্যে রোগ নির্ণয়ের হার বেশি।'
সিলেট বিভাগের হিড টিবি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-জিএফএটিএম-এর ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক রায়হান আহমেদ বলেন, 'চা বাগানের জন্য পরিচিত মৌলভীবাজার জেলা যক্ষ্মা (টিবি) সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি। এই ঝুঁকি মূলত দুর্বল পুষ্টি, স্যাঁতসেঁতে জীবনযাপন, টিবি-পজিটিভ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবের কারণে। ফলে চা বাগানের শ্রমিকরা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং রোগটি প্রায়ই অনেক দেরিতে নির্ণয় করা হয়। শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ এবং কুলাউড়া উপজেলায় সমস্ত টিবি রোগীর ৬৫ শতাংশ চা বাগানের কর্মী।'
২০২৪ সালে মৌলভীবাজার জেলায় মোট চার হাজার ৬৬৪ টিবি রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যার মধ্যে এক হাজার ৫০৩ (অথবা ৩৫ শতাংশ) জন ছিলেন চা বাগানের কর্মী।
তিনি জানান, ২০২৪ সালে মৌলভীবাজার জেলার শিশুদের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ শনাক্তের হার ছিল আট শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। সরকার ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা মৃত্যুর হার শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং সিলেট বিভাগে চলমান কাজের মাধ্যমে হিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সিলেট বিভাগীয় কনসালটেন্ট শহীদ আনোয়ার বলেন, 'চা বাগানের পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টি, তাদের ভুল ধারণা, কুসংস্কার—সবই যক্ষ্মা রোগের জন্য উপযুক্ত। সিলেট বিভাগে ১৪ বছরের কম বয়সী রোগীদের মধ্যে আট শতাংশ রোগীর যক্ষ্মার হার। শিশুরা যক্ষ্মায় আক্রান্ত দাদা/পিতামহের কাছাকাছি থাকায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ কারণে তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মা নির্ণয় করা কঠিন।'
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মোহাম্মদ নূরে আলম শামীম বলেন, 'সচেতনতার অভাব ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে কুষ্ঠরোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ। আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।'
Comments