শিশু স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হলে কী করবেন, জেনে নিন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে
একটি নামিদামি স্কুলের শিশু শিক্ষার্থী রিফাত (ছদ্মনাম)। একদিন তার মা খেয়াল করলেন, স্কুল থেকে ফিরে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করছে সে। ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেলেও যখন দেখলেন ছেলে বের হচ্ছে না, তিনি রিফাতকে ডাকলেন।
কাঁদতে কাঁদতে রিফাত বের হয়ে বলল, 'মা, আমি কি অনেক ময়লা? এজন্য কি আমি কালো?' বেশ কিছুদিন রিফাতকে স্কুলে পাঠানো যায়নি। পরে স্কুলের পদক্ষেপ এবং কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে রিফাতকে আবার স্কুলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
সহপাঠীদের অপ্রত্যাশিত আচরণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে রিফাতের মতো অনেক শিশুই। তার দেহের গড়ন কিংবা স্বভাব নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে অন্যরা, তাকে শারীরিকভাবে আঘাতও করতে পারে। স্কুলে সহপাঠী, সমবয়সীদের এসব নেতিবাচক আচরণকে বলা হয় 'বুলিং'।
ছোট্ট সন্তানটি স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হয়, তখন তা শিশুর জন্য তো অবশ্যই, বাবা-মায়ের জন্যও খুব খারাপ লাগার একটি অনুভূতি। বুলিং বিষয়টি শিশুদের শারীরিক কিংবা মানসিক ২ ভাবেই আঘাত করতে পারে। এটি একটি বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা, যা শিশুর মানসিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বুলিং শারীরিক, মানসিক উভয়ই হতে পারে। যেকোনো ধরনের বুলিং শিশুর মনে দীর্ঘস্থায়ী মনের ক্ষত তৈরি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইন্টারনেট এখন শিশুদের কাছে সহজলভ্য। সেখানে কিছু ভায়োলেন্ট কনটেন্ট বাচ্চারা দেখে ও শেখে, যা তারা সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। এতে তারা সাময়িক আনন্দ পায়।'
কীভাবে বুঝবেন শিশু বুলিংয়ের শিকার
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হলে অনেক সময় সহজে তা বলতে চায় না। শিশু প্রতিনিয়ত বুলিংয়ের শিকার হলে তার আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় শিশু স্কুল ও পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারাতে পারে, অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারে। তার মনে স্কুলভীতি জন্মাতে পারে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই না যাওয়ার জন্য নানা অজুহাত তৈরি করার চেষ্টা করবে। অন্যদের সঙ্গে খেলতেও অনীহা প্রকাশ করবে। স্বাভাবিক উচ্ছলতাও হারিয়ে যেতে পারে। মেজাজ হয়ে যেতে পারে রুক্ষ।
কেউ আবার অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, খাবার রুচি কমে যায়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। শিশু চুপচাপ হয়ে যেতে পারে, একা থাকতে পছন্দ করবে। এ ছাড়া দুশ্চিন্তা, অশান্তি কিংবা হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে। অনেকে নিজের ক্ষতিও করতে চাইতে পারে। এই বিষয়গুলো অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।
করণীয় কী
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বুলিং প্রতিরোধে দায়িত্ব নিতে হবে বাবা-মা ও শিক্ষকদের। শুধু বুলিংয়ের শিকার হলেই যে শিশুর পাশে দাঁড়াবেন তা নয়, বরং নিজের শিশু যেন অপর শিশুকে বুলি না করে সে ব্যাপারেও সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
বুলিং প্রতিকারে করণীয় বিষয়ে তার পরামর্শ হচ্ছে-
শিশুর সঙ্গে কথা বলুন
শিশুকে আপনার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে উৎসাহিত করুন। সে যেন নিজের মধ্যে কষ্টটা চেপে না রেখে আপনার সঙ্গে শেয়ার করে তেমন সম্পর্ক তৈরি করুন। বুলিং বিষয়ে সরাসরি জানতে না চেয়ে, আপনি শিশুর সঙ্গে সেসব লোকদের সম্পর্কে বলুন যারা অন্যদেরকে কথা বা কাজের মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে থাকে। এসব করা মোটেও ভালো কাজ নয় তা বুঝিয়ে বলুন। মাঝে মাঝে তার স্কুলের বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চান, কাদের সে পছন্দ করে না এবং কেন করে না। কথা বলার সময় যাতে শিশুরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেদিকে নজর রাখুন।
কী করতে হবে শিশুকে শেখান
শিশুকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আগে থেকেই শিশুকে শিখিয়ে দিন কষ্ট না পেয়ে বা কান্নাকাটি না করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বুলিংয়ের প্রতিবাদ করতে। বুলিংয়ের ফলে তাদের কেমন অনুভব হয় সেটা বুঝিয়ে বলতে, যাতে যারা কাজটি করে তারা বুঝতে পেরে এসব বন্ধ করে।
তাতে না হলে শিশুকে শেখাতে হবে, বুলিং ব্যাপারটা ঘটে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য। যেমন- তোমাকে রাগিয়ে তুলবে বা কষ্ট দেবে এমন কিছু ভেবে এটা করা হয়। যারা করে তারা যদি বুঝতে পারে এতে তুমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছ না, তাহলে তারা সেটি এড়িয়ে যাবে। আপনার শিশুকে প্রতিক্রিয়া না জানাতে বলুন। যেন সে না শোনার ভান করে।
আপনার জায়গা থেকে যেটি করতে পারেন সেটি হলো, শিশুকে সাহস দিন। তার পাশে থাকুন, সবসময় আপনি তার পাশে আছেন বোঝান। বুলিং যদি চলতেই থাকে তাহলে শিশুর শিক্ষকদের সঙ্গে বা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন। তাদেরকে বিষয়টি জানিয়ে সমাধান চান।
সতর্ক হতে হবে শিক্ষকদের
শিশুরা দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকে স্কুলের শিশু বুলিং শিকার হচ্ছে কি না সেটি শিক্ষক ও প্রশাসনের নজরদারিতে থাকা উচিত। স্কুল থেকেও কাউন্সিলিং করাতে হবে যে বুলিং কেন অপকারী, কী ক্ষতি হয়, করা উচিত নয় কেন। কোনো শিক্ষার্থী যদি বুলিংয়ের শিকার হয় তার পাশে থাকতে হবে।
স্কুলে বুলিংয়ের কারণে শিশুর মনে যে ক্ষত তৈরি হয় সেটি শিশুমনে মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ কিছু ক্ষেত্রে কাউন্সিলিং ও ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে।
Comments