ইউরিন ইনফেকশনের কারণ ও লক্ষণ কী, প্রতিরোধে কী করবেন

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান সময়ে ইউরিন ইনফেকশন খুবই পরিচিত একটি রোগ। নারী বা পুরুষ উভয়ই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে ও কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে এই রোগ থেকে সহজেই নিরাময় পাওয়া সম্ভব।

বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলেছি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. তানজীর ইসলাম অদ্বিতের সঙ্গে। চলুন তার কাছ থেকে জেনে নিই ইউরিন ইনফেকশনের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে -

ইউরিন ইনফেকশন কী

আমাদের শরীরে থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি প্রস্রাব হিসেবে বেরিয়ে যায়। প্রস্রাব বেরিয়ে যাওয়ার এই ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত অঙ্গগুলো নিয়ে আমাদের মূত্রতন্ত্র গঠিত। মূত্রতন্ত্রের মধ্যে থাকে ২টি কিডনি, ২টি ইউরেটার, একটি মূত্রথলি বা ব্লাডার ও একটি মূত্রনালি।

মূত্রতন্ত্রের কোনো অংশে জীবাণুর সংক্রমণ হলে সেটিকে ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্রমণ বলে। ডাক্তারি ভাষায় একে 'ইউরিনারি ট্র‍্যাক ইনফেকশন ' বা ' ইউটিআই ' বলা হয়।

ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ

ইউরিন ইনফেকশনের অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত কিছু লক্ষণ আছে। সেগুলো হলো -

●         প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হওয়া

●         স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া

●         রাতে বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়া

●         অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত বা ঘোলাটে প্রস্রাব হওয়া

●         হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ হওয়া বা বেগ ধরে রাখতে কষ্ট হওয়া

●         তলপেটে ব্যাথা হওয়া

●         প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া

●         কোমরের পেছনে পাঁজরের ঠিক নিচের অংশে ব্যাথা হওয়া

●         জ্বর আসা কিংবা গরম লাগা বা শরীরে কাঁপুনি লাগা

●         শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া

●         ক্লান্তি ও বমি বমি লাগা

ওপরের লক্ষণগুলোর পাশাপাশি বয়সভেদে প্রস্রাবের ইনফেকশনের লক্ষণগুলোতে কিছুটা ভিন্নতা দেখা দিতে পারে।

বয়স্ক ও প্রস্রাবের নল (ক্যাথেটার) দেওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলো হলো—

●         অস্বাভাবিক আচরণ

●         মানসিক বিভ্রান্তি অথবা ক্ষোভ

●         নতুন করে শরীরে কাঁপুনি অথবা ঝাঁকুনি হওয়া

●         প্রস্রাব করে জামাকাপড় নষ্ট করে ফেলা

আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাধারণ লক্ষণগুলোর পাশাপাশি ভিন্ন ধরনের কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন—

●         মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া

●         ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা বন্ধ করে দেওয়া

●         জ্বর আসা বা শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া

●         ঘন ঘন প্রস্রাব করা কিংবা হঠাৎ বিছানায় প্ৰস্রাব করতে শুরু করা

●         বমি হওয়া

ইউরিন ইনফেকশনের কারণ

সাধারণত পায়খানায় থাকা বিভিন্ন জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে ইউরিন ইনফেকশন ঘটায়। প্রস্রাবের রাস্তা বা মূত্রনালী দিয়ে এসব জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে। নারী-পুরুষভেদে সবারই প্রস্রাবের ইনফেকশন হতে পারে। তবে নারীদের মধ্যে এই রোগের সংক্ৰমণের হওয়ার প্রবণতা বেশি। এর কারণ হলো, নারীদের মূত্রনালী পুরুষদের মূত্রনালীর তুলনায় দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট।

এ ছাড়া নারীদের মূত্রনালী পায়ুপথের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে ব্যাকটেরিয়া পায়ুপথ থেকে মূত্রনালীতে প্রবেশ করে প্রস্রাবের সংক্ৰমণ ঘটানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়।

যেসব কারণে ইউরিন ইনফেকশনের আশঙ্কা বেড়ে যায়—

● পর্যাপ্ত পানি পান না করলে

● মূত্রতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এমন রোগ হলে। যেমন: কিডনিতে পাথর হওয়া

● যৌনাঙ্গ পরিষ্কার ও শুকনো না রাখলে

●  যেকোনো কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে। যেমন: টাইপ ২ ডায়াবেটিস অথবা এইচআইভি আক্রান্ত হলে, কেমোথেরাপি অথবা দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবনকালে, গর্ভধারণ করলে

● মূত্রথলি পুরোপুরি খালি করতে বাধা সৃষ্টি করে এমন রোগ হলে। যেমন: পুরুষদের 'প্রস্টেট গ্রন্থি' বড় হয়ে যাওয়া, শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো অসুখ

●  মাসিক চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলে। এই ঘটনাকে 'মেনোপজ' বলা হয়। এক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন কমে যাওয়ায় সংক্ৰমণ প্রবণতা বেড়ে যায়

●  প্রস্রাবের রাস্তায় নল বা ক্যাথেটার পরানো থাকলে

●  আগে প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়ে থাকলে

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে করণীয়

প্রস্রাবের ইনফেকশন সবসময় প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু নিয়ম মেনে চললে ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়।

যা করবেন

● টয়লেটে টিস্যু ব্যবহারের সময়ে সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করুন

● যৌনাঙ্গ শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন।

● প্রচুর পানি পান করুন। দৈনিক কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত

● বাথটাব বা পুকুরে গোসল করার পরিবর্তে শাওয়ার কিংবা বালতির সাহায্যে গোসল করুন

●  প্রস্রাব করার সময়ে মূত্রথলি সম্পূর্ণ খালি করার চেষ্টা করুন

● সহবাসের আগে ও পরে যৌনাঙ্গ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন

● সহবাসের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্রাব করুন

●  সুতি কাপড়ের ঢিলেঢালা অন্তর্বাস ব্যবহার করুন।

●  ১ থেকে ৩ বছর বয়সী বাচ্চার ডায়পার বা কাপড়ের ন্যাপি নিয়মিত পরিবর্তন করুন।

যা করবেন না

●  প্রস্রাবের বেগ আসলে তা ধরে রাখবেন না

●  প্রস্রাব করার সময়ে তাড়াহুড়ো করবেন না

●  যৌনাঙ্গে সুগন্ধি সাবান অথবা ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করবেন না

●   সিনথেটিক কাপড়ের (যেমন: নাইলন) তৈরি আঁটসাঁট অন্তর্বাস ব্যবহার করবেন না

●   আঁটসাঁট পায়জামা পরবেন না

●   চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় খাবেন না। এগুলো জীবাণু বেড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে

●  যেসব কনডম অথবা ডায়াফ্রামে শুক্রাণু ধ্বংস করার পিচ্ছিলকারক থাকে সেগুলো ব্যবহার করবেন না। এর পরিবর্তে ভিন্ন ধরনের কনডম ও লুব্রিকেন্ট কিংবা জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করুন।

ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসা

ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে সেগুলো উপেক্ষা না করে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার প্রস্রাব পরীক্ষা করানোর পাশাপাশি প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।

অ্যান্টিবায়োটিকের সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষণগুলো কমে আসতে শুরু করলেও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধের কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।

সাধারণত ওষুধ খাওয়া শুরু করার ২-৩ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো কমতে শুরু করে। যদি ওষুধের কোর্স সম্পন্ন করার পরেও লক্ষণের উন্নতি না হয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

যে কারণে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হন

রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে ইউরিন ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকে। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের মূল কারণ 'ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া'। আমাদের অন্ত্রেই এই ব্যাকটেরিয়া থাকে। ইউরিনারি ট্র্যাক্টের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করলেই সমস্যা দেখা দেয়।

ইউরিন ইনফেকশনের জন্য নারীদের যৌনাঙ্গের গঠনও কিছু দায়ী। যেহেতু এর গঠন উন্মুক্ত, তাই কর্মক্ষেত্র, শপিং মলে কমন টয়লেট ব্যবহারে সমস্যায় পড়তে হয়। এ ছাড়াও পিরিয়ডের সমস্যা, নিয়মিতভাবে হরমোনের ওষুধ খাওয়া ইত্যাদি কারণে ইউরিন ইনফেকশন হয়।

নারীদের মূত্রদ্বারের কাছেই থাকে মলদ্বার। এই কারণেও কিন্তু ইনফেকশনের সমস্যা অনেক বেশি হয়। অনেক সময় যৌনতা থেকেও হতে পারে ইউরিন ইনফেকশন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

2h ago