চাইল্ডহুড ট্রমার কারণ ও পরবর্তী জীবনে প্রভাব, চিকিৎসা কী

চাইল্ডহুড ট্রমা
ছবি: সংগৃহীত

চাইল্ডহুড ট্রমা প্রাপ্তবয়সে মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই ট্রমা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

চাইল্ডহুড ট্রমা কী ও কেন হয়

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকেই একটি শিশুর ট্রমা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের যদি কোনো ট্রমা হয়, মা যদি কোনো মানসিক বিপর্যয়ের দিকে যান, তখন সেটির প্রভাব গর্ভে থাকা শিশুর ওপরেও পড়ে।

জন্মের পর থেকে পরবর্তী শৈশব এবং কৈশোরে যত ধরনের শারীরিক, মানসিক অথবা যেকোনো ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে শিশু পড়ে, তার প্রত্যেকটি অ্যাডভার্স চাইল্ডহুড এক্সপেরিয়েন্সেস বা প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা। এই প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতাকেই সাধারণ ভাষায় বলা হয় ট্রমা। গর্ভাবস্থায় অর্থাৎ ০ দিন থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেককে শিশু বলা হয়। তাই এই সময়ে যে ট্রমা সেটিই চাইল্ডহুড ট্রমা।

অ্যাডভার্স চাইল্ডহুড এক্সপেরিয়েন্সের মধ্য দিয়ে যেসব শিশু যায় তাদের ট্রমা হয়। বিভিন্ন কারণে চাইল্ডহুড ট্রমা হতে পারে। যেমন-

  • গর্ভস্থ শিশুদের ক্ষেত্রে মা যদি কোনো পারিবারিক সংহিসতা, মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যান, তাহলে সেটি গর্ভস্থ শিশুর উপর প্রভাব ফেলে। যত্ন পাওয়া শিশুর অধিকার। শিশু জন্মের পরে যদি সঠিক যত্ন না পায়, তখন সেই শিশুর এক ধরনের প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা হয়, তার ট্রমা হয়। কোনো শিশু যত্ন পেল না, খাদ্য, পুষ্টি, কিংবা শিক্ষা পেল না সেটাও এক ধরনের ট্রমা।
  • অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, বৈষম্যের শিকার, এ ছাড়া শৈশবে কোনো কারণে যদি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বা পরিবার, স্কুলে বা কোথাও যদি শারীরিকভাবে আঘাত পায় সেটাও শিশুর ট্রমার কারণ।
  • শিশুকে আঘাত দিয়ে কথা বলা, মনের ওপর চাপ তৈরি হওয়ার কারণে ইমোশনাল ট্রমা হতে পারে।
  • যৌন নির্যাতন খুব বেশি ঘটছে, যা থেকে শিশুর ট্রমা হয়। বিশ্বব্যাপি প্রতি ৪টি মেয়ে শিশুর মধ্যে ১ জন এবং প্রতি ৬টি ছেলে শিশুর মধ্যে ১ জন জীবনে কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
  • শিশু সরাসরি কোনো নির্যাতনের শিকার হলো না কিন্তু পারিবারিক সংহিসতা দেখল, বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া, অশান্তি, বিবাদ দেখল, সেটিও তার জন্য ট্রমা। এ ছাড়া পরিবারে কারো মধ্যে যদি অপরাধের ইতিহাস থাকে, কোনো ধরনের সমস্যা থাকে সেটাও এক ধরনের ট্রমা।
  • শিশু যদি সরাসরি নানাভাবে কখনো ট্রমার ভুক্তভোগী হিসেবে নিজেকে প্রত্যক্ষ করে, মৌখিকভাবে বুলিংয়ের শিকার হয় স্কুলে বা বিভিন্ন স্থানে, আবার  নিজে ট্রমার ভুক্তভোগী না কিন্তু অন্য কারো ভেতর ট্রমাগুলো দেখছে যেমন- পরিবারের ভেতর মারপিট, ঝগড়া, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ- এ সবকিছুই শিশুর ট্রমা হিসেবে কাজ করে।

লক্ষণ

১. শৈশবে শিশুর ট্রমা হলে শিশু ঠিকমত খেতে চায় না

২. শিশুর চিন্তা, আচরণ ও ঘুমের পরিবর্তন হয়

৩. বিছানায় প্রস্রাব করে

৪. ভয়ার্ত হয়ে যায়, ভয় পায়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে

৫. লেখাপড়া ব্যাহত হয়, পরীক্ষার ফল খারাপ হতে থাকে

৬. কারো সঙ্গে মেলামেশা ও খেলাধুলা করতে চায় না

৭. সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয় না

পরবর্তী জীবনে চাইল্ডহুড ট্রমার প্রভাব

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, ট্রমা শিশুর স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে।

স্বল্পমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

স্বল্পমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ভেতর শিশুর উদ্বিগ্নতা বাড়ে, আচরণে সমস্যা হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, ঘুমের সমস্যা হয়, ৫ বছর বয়সের পরও শিশু বিছানায় প্রস্রাব করে, অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে যায়।

দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বের ব্যাধি হতে পারে তার ভেতরে। দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হিসেবে সে নিজেও আরেক জনকে ট্রমাটাইজড করতে পারে ভবিষ্যতে, যদি সে নিজে কখনো ট্রমার মুখোমুখি হয়ে থাকে।

তার ধারণার জগৎ পরিবর্তন হয়। যখন তার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়ে যায়, তখন সমাজ থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলে, দীর্ঘমেয়াদী সর্ম্পক বজায় রাখতে পারে না, সর্ম্পকের জায়গায় জটিলতা তৈরি হয়, বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়। এমনকি ভবিষ্যতে সিজোফ্রেনিয়াসহ বিভিন্ন মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়, শিশু যদি শৈশবে ট্রমার মুখোমুখি হয়।

কখনো কখনো চাইল্ডহুড ট্রমা থেকে শিশু শৈশবে নিজেকে আঘাত করে, আত্মহত্যার প্রবণতা থাকতে পারে এবং ভবিষ্যতেও তার ভেতরে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়। চাইল্ডহুড ট্রমা শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে মানসিক রোগের দিকে ধাবিত করতে পারে।

ট্রমার চিকিৎসা

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, শিশুর ভেতরে যদি আচরণের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ বা ট্রমার লক্ষণ দেখা যায় তাহলে শিশুকে ধমক দেওয়া যাবে না। শিশুর সমস্যাকে এড়িয়ে না গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। শিশুর যদি কাউন্সিলিং প্রয়োজন হয়, বাবা-মায়ের যদি প্যারেন্টিং ওরিয়েন্টেশন দরকার হয় কিংবা ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন হয় সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

প্রতিরোধ

ট্রমা প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি গণমাধ্যমসহ সচেতন হতে হবে সবাইকে। সমস্যা চিহ্নিত করলেই হবে না বরং তা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে।

১. পরিবারগুলোকে শিশুবান্ধব হতে হবে। ট্রমার বিষয়গুলো বুঝতে হবে, ট্রমার পরিণতি কী হতে পারে তা বুঝতে হবে।

২.  ট্রমা নিয়ে প্যারেন্টিং ট্রেনিং বা বাবা-মা ও অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

৩. আমরা অনেক সময় অজান্তেই শিশুর জন্য ট্রমা তৈরি করি। আমরা হয়তো জানি না, এমন কিছু শব্দ বা কথা বলে ফেলি যেটা বুলিং হতে পারে যা শিশুর জন্য ট্রমার কারণ হতে পারে। মজার ছলে বলা অনেক কথা ট্রমার কারণ হতে পারে। সেদিকে সর্তক হতে হবে।

৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শিশুবান্ধব হতে হবে।

৫. শিশু কোন কোন বিষয়ে ট্রমাটাইজড হচ্ছে সেগুলো বুঝতে হবে। ট্রমা মানে শুধু শরীরে আঘাত করা নয়, তাকে একটি কথা বা শব্দের মধ্য দিয়ে, তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে ট্রমাটাইজড করা যায়।

৬. সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিশু পার্কে যায়, প্রার্থনার জন্য বিভিন্ন উপসনালয়ে যায়। সেখানে যথেষ্ট সম্মান পায় কি না, পথেঘাটে শিশু ট্রমার শিকার হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৭. রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন করতে হবে। এটা কোনো আইন দিয়ে করা যাবে না। মানসিক স্বাস্থ্যকে যদি শিশুবান্ধব করা না যায় তাহলে আইন দিয়ে শিশুর ট্রমা বন্ধ করা যাবে না।

 

Comments

The Daily Star  | English
CSA to be repealed

CSA to be repealed within a week: Nahid Islam

About the election, Nahid said an election based on national consensus will be held after completing all necessary reforms.

3h ago