ভরসা এখন মুরগির ফাটা ডিম আর গিলা-কলিজায়

কারওয়ান বাজারে মুরগির গিলা-কলিজার কিনছেন এক ক্রেতা। ছবিটি শুক্রবার সন্ধ্যায় তোলা। ছবি: সুমন আলী/স্টার

বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম ২ মাসের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায়। প্রতি ডজন মুরগির ডিমের (লাল) দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়।

প্রোটিনের সবচেয়ে সস্তা উৎস হিসেবে পরিচিতি ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এখন ঝুঁকছেন মুরগির গিলা-কলিজা, গলা ও পা কেনার দিকে। ডিমের দামও বেড়ে যাওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম দামে কিনছেন ফেটে যাওয়া ডিম।

গত ৩ দিনে ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে মুরগির গিলা-কলিজা, গলা, পা ও ফাটা ডিম বিক্রি হয় এমন দোকানগুলোর সামনে ১ ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে থাকেন এই প্রতিবেদক। এ সময় অন্তত ১৫ জনকে এগুলো কিনতে দেখেন তিনি।

তাদের মধ্যে ৫ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। আরও ৪ জনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।

বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩ দিনের ব্যবধানে গিলা-কলিজার দামও ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার ক্রেতা সেজে ৩টি দোকানে গিলা-কলিজার দাম জিজ্ঞাসা করা হয়। বলা হয়, শুধু গিলা-কলিজা প্রতি কেজি ১৬০ টাকা এবং গলাসহ গিলা-কলিজা ১৫০ টাকা।

শুক্রবার একই গিলা-কলিজার দাম চাওয়া হয় ২০০ টাকা এবং গলাসহ গিলা-কলিজা ১৮০ টাকা।

আজ শনিবার সেখানে প্রতি কেজি গিলা-কলিজা ২০০ টাকা, গলাসহ গিলা-কলিজা ১৮০ টাকা এবং কেবল মুরগির পা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।

নাম ও ছবি প্রকাশ না করা শর্তে বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে কথা হয় শিল্পী বেগমের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি বলেন, '১ মাস আগেও ১৪০ টাকা দিয়ে ব্রয়লার মুরগি কিনতাম। এখন দাম ২৫০ টাকা। আয় তো বাড়েনি। তাই গিলা-কলিজা কিনতেছি। কী করবো বলেন, ছেলেমেয়েরা শুধু সবজি দিয়ে ভাত খেতে চায় না।'

শিল্পী বেগম বলেন, 'আমার মেয়ে একটা বিড়াল পালে। তার জন্য আগে মুরগির গলা কিনতাম ১০০ টাকা করে। এখন গলার দামও বেড়েছে। প্রতি কেজি গলা নিচ্ছে ১৪০ টাকা। মানুষ নাকি অনেকেই গলা কিনছেন এখন।'

রিকশা চালক মো. রইসুল মিয়া বলেন, 'আমি কখনো গিলা-কলিজা কিনতাম না। এমনকি বাড়িতে যে মুরগি নিয়ে যেতাম সেখান থেকে গিলা-কলিজা ফেলে দিতাম। এখন মুরগির যে দাম তাতে কেনার সামর্থ্য নেই। বাধ্য হয়ে এখন গিলা-কলিজা ও গলা কিনি।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নারী বলেন, 'ব্রয়লার মুরগি ১ কেজি কিনেছি। সঙ্গে ২ কেজি গিলা-কলিজা। আমরা গিলা-কলিজা দিয়েই চলতে পারব। কিন্তু ছেলেমেয়েরা তো মাংস খেতে চায়। ৪ থেকে ৫ পিস মাংস আর গিলা-কলিজা রান্না করব। উপায় নেই। এভাবেই চলতে হবে।'

সেই নারী তার ছবি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'ছবি প্রকাশ পেলে আত্মীয়-স্বজনরা জেনে যাবে আমাদের অবস্থা। তারা সবাই জানেন ঢাকায় আমরা অনেক ভালো আছি। কিন্তু আমরা কেমন আছি সেটা আমরা জানি। আর আল্লাহ ভালো জানেন।'

হুসনে আরা (ছদ্মনাম) কারওয়ান বাজার থেকে ১ মাস ধরে নিয়মিত মুরগির ফাটা ডিম কেনেন। হালি কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ভালো ডিমের হালি নেয় ৪৫ টাকা আর ফাটা ডিমের হালি ৩০ টাকা। ১ থেকে দেড় মাস আগে ভালো ডিম কিনতাম ২৮ থেকে ৩০ টাকা হালি।

কারওয়ান বাজারে মুরগির ফাটা ডিম কিনছেন এক নারী। ছবি: সুমন আলী/স্টার

'আগে মুরগির মাংস কিনতাম। এখন আর পারি না। মুরগির গলা, ঠ্যাং আর গিলা-কলিজা কিনি। সবজির ভাগা কিনি।'

বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সোহেল বলেন, 'গরুর মাংস কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা। মাছের দাম বাড়তি। ব্রয়লার আগে তেমন খাওয়া হতো না। মাঝখানে কিছুদিন কিনেছিলাম। এখন সেটাও কিনতে পারি না।'

শুক্রবার গিলা-কলিজা কিনতে আসেন হাসিনা খাতুন (ছদ্মনাম)। তিনি দোকানদারের সঙ্গে এক প্রকার ঝগড়া শুরু করে দেন। কারণ জানতে চাইলে হাসিনা খাতুন বলেন, 'গতকাল গিলা-কলিজার দাম ছিল ১৫০ টাকা। আজ চাচ্ছে ২০০ টাকা। কোনো কারণ ছাড়াই দাম বেশি চাচ্ছে। দেশটা মগের মুল্লুগ পাইছে।'

কারওয়ান বাজারে গিলা-কলিজা বিক্রেতা মো. রহমতুল্লাহ শুভ আজ শনিবার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৃহস্পতিবারের চেয়ে গিলা-কলিজার দাম কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেশি। কারণ চাহিদা অনেক বেশি। বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি গিলা-কলিজা বিক্রি করেছি ১৬০ টাকায়, আজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়।'

প্রতিদিন কী পরিমাণ গিলা-কলিজা বিক্রি হয় জানতে চাইলে শুভ বলেন, 'আগে মানুষ তেমন একটা গলা, গিলা-কলিজা কিনত না। যাদের কুকুর-বিড়াল আছে তারা শুধু কিনতেন। কিন্তু এখন অনেকেই কিনেন। আগে প্রতিদিন বিক্রি হতো ১৫ থেকে ২০ কেজি। এখন বিক্রি করি ৩০ থেকে ৪০ কেজি।'

ডিম বিক্রেতা আনোয়ার আলী বলেন, 'যাদের টাকা পয়সার সমস্যা তারা ফাটা ডিম কেনেন। ফাটা ডিমগুলো ভেঙে শুধু কুসুমগুলো পলিথিনে করে নিয়ে যান। প্রতি হালি ফাটা ডিম ৩০ টাকায় বিক্রি করি। ডিমের দাম বাড়ার পর থেকে অনেকেই ফাটা ডিম কিনছেন। প্রতি দিন ৬০ থেকে ৩০ পিসের মতো ফাটা ডিম বিক্রি করি। আগে করতাম ২০ থেকে ২৫ পিস।' 

 

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago