‘টুকরি’তে বাঁধা পড়া টুকরো জীবন
দুই বছর আগে ঢাকা শহরে এসে আগারগাঁও বস্তিতে এক আত্মীয়ের কাছে ওঠেন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের বাসিন্দা মো. আতাউল্লাহ (২৬)। এসে রোজগারের আশায় বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন।
রিকশার গ্যারেজে গিয়ে কাজ পাননি আতাউল্লাহ। কোনো দোকানেও কাজ দেয়নি কেউ। সবজির ভ্যান নিয়েও বসতে পারেননি সামান্য পুঁজির অভাবে।
অবশেষে এই যুবক যান কারওয়ান বাজারে। জানতে পারেন মিন্তি হিসেবে টুকরি নিয়ে মাল বহনের কাজ করতে পারবেন। টুকরি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করলেন। নতুন আসায় ৩০০ টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে টুকরি ভাড়া নিয়ে শুরু হলো তার মিন্তিজীবন।
এখন তিনি কারওয়ান বাজারের পরিচিত মিন্তি। টুকরি ভাড়া নেন, প্রতিদিন আয় করেন ৮০০-১০০০, খরচ শেষে হাতে থাকে অন্তত ৫০০-৬০০।
কারওয়ান বাজার এলাকায় যাদের নিয়মিত যাতায়াত তারা সবাই মিন্তিদের ব্যবহার করা বাঁশের তৈরি এসব ঝুড়ি বা টুকরির সঙ্গে পরিচিত।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচামালের আড়ত এই কারওয়ান বাজারে। এ এলাকায় মিন্তিরা মাথায় ঝুড়িভর্তি করে অন্যের বাজার বয়ে বেড়ান। এতে যে টাকা আসে, তা দিয়ে নিজের টুকরো জীবনের পাশাপাশি পরিবারকেও চালান।
আবার প্রায়ই দেখা যায় বিশ্রামের জন্য এই টুকরিতেই শরীর এলিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ।
এই ঝুড়ি বা টুকরিগুলো কিন্তু মিন্তিদের নিজেদের নয়। তারা এগুলো ভাড়া নিয়ে থাকেন।
শ্রমিকরা জানান, ৩৮টি গ্রুপ এই ঝুড়িগুলো ভাড়া দেয়। তাদের কাছে থাকা প্রায় ৫ হাজারের মতো টুকরি আছে কারওয়ান বাজারে, যেগুলো শ্রমিকদের প্রতিদিন ভাড়া দেওয়া হয়।
টুকরির মালিকরা জানান, ১৯৯০ সাল থেকে কারওয়ান বাজারে এই টুকরি ভাড়া দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। কয়েকজন টুকরি মালিক মিলে একটি গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের টুকরিগুলোতে শনাক্তকরণ চিহ্ন এঁকে দিয়ে শ্রমিকদের কাছে টুকরি ভাড়া দিয়ে আসছেন।
বর্তমানে ৩৮টি গ্রুপের কাছে সর্বনিম্ন ৫০টি থেকে ৪৫০ পর্যন্ত টুকরি আছে।
তারা আরও জানান, প্রথমদিকে প্রতিটি টুকরি দৈনিক ৫ টাকা করে ভাড়ায় দেওয়া হতো। বর্তমানে টুকরি ভাড়া ৩০ টাকা। একটি টুকরি একজন শ্রমিকের কাছে ২৪ ঘণ্টার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। এক ঘণ্টার জন্য নিলেও ভাড়া ৩০ টাকা।
টুকরি ভাড়া নিয়ে শ্রমিকরা কারওয়ান বাজারের ক্রেতাদের হয়ে সবজি, মুদিদ্রব্য, মাছ, শুকনো মালামাল আনা-নেওয়া করেন।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মো. আলাউদ্দিন (৩০) গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে শ্রমিকের কাজ করে আসছেন। তিনি টুকরি ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মালামাল বহন করেন।
আলাউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারওয়ান বাজারে বিভিন্ন জিনসপত্র কিনতে আসা মানুষের কুলির কাজ করি আমরা। আমরা বলি "মিন্তির" কাজ। টুকরিতে মাল নিয়ে রাস্তা পার করে দিলে ৫০ টাকা পাই, রিকশায় উঠায় দিলে পাই ৩০ টাকা।'
তিনি জানান, পুরো এক মাস কাজ করে ১০-১২ দিনের জন্য গ্রামে চলে যান। বাড়িতে যাওয়ার সময় ১০-১২ হাজার টাকা নিয়ে যেতে পারেন।
তিনি বলেন, 'মিন্তির কাজ করে দৈনিক আয় হয় ৬০০-১০০০ টাকা। দুইবেলা খাওয়ার জন্য ১৫০ টাকা খরচ হয়। সকালের নাস্তার খরচ ৫০, সারাদিনের হাতখরচ ১০০ টাকা। যার টুকরি তার কাছেই থাকি। আড়তের দোতলায় ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ঘুমাই। তারা একটা কাথা, একটা চাদর, একটা বালিশ ও একটা মশারি দেয়।'
'রিকশা চালালেও এমনই রোজগার হয় শুনেছি। তাই আর অন্য কাজ খুঁজি না। এটা তুলনামূলক সহজ কাজ। যারা রিকশা চালায় তাদের চেয়ে আমি খারাপ নেই,' বলেন আলাউদ্দীন।
কারওয়ান বাজারের আরেক কুলি সোহাগ মিয়ার (৩৬) বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে। আগে তিনি রিকশা চালাতেন। গত এক বছর ধরে কুলির কাজ করছেন।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ কাজে কোনো ঝামেলা নেই, স্বাধীন কাজ। রিকশা চালালে রিকশার জমার টাকা বের করার চিন্তা থাকে সারাদিন। গ্যারেজের পরিবেশ ভালো না। তাই আমি মনে করি কষ্ট হলেও মিন্তির কাজ করা ভালো।'
টুকরি মালিকদের ৩৮টি গ্রুপের মধ্যে অন্যতম মোসলেমউদ্দীন, সজীব ও খলিলের গ্রুপ। তাদের অধীনে মোট ৪৫০টি টুকরি। খলিলের নামের আদ্যাক্ষর 'কে' লেখা আছে তাদের সবগুলো টুকরিতে। টুকরিতো রাখা হয় কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে।
মোসলেমউদ্দীন ডেইলি স্টারকে জানান, ১৯৯০ সালে পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে টুকরির কারবার শুরু হয়েছিল। তখন অনেক শ্রমিক নিজেরাই টুকরি নিয়ে এসে কাজ করত। পরে টুকরি রাখার ঝামেলা, হারিয়ে যাওয়া, চুরি হওয়ার ভয় থেকে টুকরি ভাড়া প্রথা শুরু হয়।
সম্প্রতি কারওয়ান বাজার বস্তি ভেঙে দেওয়ায় টুকরির ব্যবসা জমে উঠেছে। এখানকার কুলিদের শতকরা ৯৫ জন টুকরি ভাড়া নিয়ে নিজেদের রোজগার করে থাকেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, গত চার বছর ধরে টুকরি ব্যবসা জমজমাট। গত বছর ৩০ টাকা ভাড়া হয়। এর আগে ১০ বছর ধরে দৈনিক টুকরি ভাড়া ছিল ২০ টাকা।
মোসলেমউদ্দীন বলেন, 'আমি গত ২০ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে টুকরি ভাড়া দেই। সারাদিন ধরেই শ্রমিকরা আসে, টুকরি ভাড়া নেয়। এই টুকরি ভাড়া দিয়েই সংসার চালাচ্ছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি।'
'প্রায় প্রতিদিনই সবগুলো টুকরি ভাড়া হয়। আর সবগুলো ভাড়া হলেই সাড়ে ১৩ হাজার টাকা পাই। মাস শেষে তিনজনের প্রত্যেকের হাতে ৭০-৮০ হাজার টাকা থাকে,' বলেন তিনি।
মোসলেম জানান, টুকরিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের একটা খরচ আছে প্রতিমাসে। টুকরি নষ্ট হয়, চুরি হয়।
তিনি বলেন, 'প্রতি মাসেই অন্তত ৫০টি টুকরি পাল্টাতে হয়। সব মিলিয়ে এক লাখ টাকা খরচ আছে। টুকরির জন্য বাঁশ কিনে নিজেরাই বানাই, মেরামত করি। প্রতিটি টুকরির দাম পড়ে ৯০০ টাকা।'
মোসলেম জানান, কারওয়ান বাজারে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় চাঁদাবাজির মতো টুকরি ভাড়ার ক্ষেত্রেও আগে চাঁদাবাজি ছিল। তখন আয়ের একটা বড় অংশ দিয়ে চাঁদা হিসেবে দিতে হতো।
'তবে, এখন চাঁদা নাই, থাকলেও খুব অল্প,' বলেন তিনি।
Comments