‘সরকারের দুর্বলতা-নিষ্ক্রিয়তায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে’

সরকার 'ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম সমন্বয়' করতে ১৯ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস-তেল-কয়লার মতো জ্বালানির দামবৃদ্ধি পাওয়ায় তারাও দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু, তাদের এই যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সরকার অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের 'দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তা'র কারণেই এভাবে দামবৃদ্ধি করা হয়েছে। জাতীয় সক্ষমতা না বাড়িয়ে একটা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে মূলত নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এই সমন্বয়ের কথা বলে এখন অবিরাম তারা দাম বাড়াতে থাকবে।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে জ্বালানি আমরা ব্যবহার করছি, সেটার দাম অনেক বেশি। এই উচ্চমূল্যের জ্বালানি ব্যবহার করা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল না। কারণ, এর বিকল্প হিসেবে আমাদের দেশের মাটির নিচের ৩ ডলারের গ্যাস রয়েছে।'

তিনি বলেন, 'বলা হয়, আমাদের দেশের গ্যাস অনুসন্ধান থেকে শুরু করে উত্তোলন একটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবে আমাদের চলমান যেসব গ্যাসকূপ আছে, সেখান থেকেই আমরা বাড়তি গ্যাস পেতে পারি। ২০১১ সালে একটি বিশ্বখ্যাত কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে কাজ করতে নিয়োগ করেছিল সরকার। তাদের কাজ ছিল, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের গ্যাসকূপগুলোর উৎপাদন কম হওয়ার কারণ খুঁজে বের করা। তারা বাংলাদেশের ৫০টি গ্যাসকূপ চিহ্নিত করে দেখিয়েছিল যে এগুলোতে খুবই ছোটখাটো কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হলে, খুবই অল্প কিছু যন্ত্রাংশ যোগ করলে, আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন সম্ভব।'

'তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এসব ছোটখাটো অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হলে চিত্র ভিন্ন হতে পারতো, স্পট মার্কেট থেকে আমাদেরকে গ্যাস কিনতে হতো না। মাঝে তো স্পট মার্কেটে দাম এত বেশি ছিল যে আমরা গ্যাস কিনতেই পারছিলাম না। দেশীয় কয়লা ব্যবহার না করে আমরা আমদানি করছি। অথচ, যে কয়লার দাম ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ১০০ ডলারের কম ছিল, সেটা এখন ৩৫০ ডলারের কাছাকাছি', বলেন তিনি।

অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, 'নিজেদের কতগুলো দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তা আজ আমাদেরকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব তো কিছুটা পড়তেই পারে। কিন্তু আমরা যে পরিস্থিতিতে পড়েছি, সেটা বৈশ্বিক কারণে হয়েছে বলে আমি মনে করি না। নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও এতটা খারাপ অবস্থায় পড়ার কোনো কারণ নেই। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে তার প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়বে। কিন্তু নিজেদের সম্পদ থাকার পরেও সেই প্রভাব বাড়তে দেওয়া যৌক্তিক না।'

বিদ্যুৎ ও তেলের দামবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে যেসব যুক্তি শোনা যায়, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেসব যুক্তির মধ্যে ভুল, মিথ্যা এবং সত্য গোপন করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার মতো করে কথা সাজানোর চেষ্টা থাকে বেশি। কারণ, সরকার যখন তেলের দামবৃদ্ধি করে, সেটার কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর একটা ভয়ংকর চাপ তৈরি হয়, সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এর ফলাফল বোঝাটা তো সরকারের জন্য কঠিন না। সেটা বুঝলে সরকারের উচিত ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও তাদের হাতে থাকা মুনাফার ৪৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে তা সমন্বয় করা। ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল বাংলাদেশের বাজারের চেয়ে অনেক কম। সেই কারণেই বাংলাদেশ এই মুনাফা করতে পেরেছে। অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা এবং এর ওপরে ভার চাপানোর কোনো প্রবণতা না থাকলে সরকার সেই মুনাফা থেকে সমন্বয় করতে পারত।

সরকার এখন সমন্বয় শব্দটা বেশি ব্যবহার করছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া এই শব্দটির অর্থ হিসেবে সরকার দামবৃদ্ধিই বোঝায়। কখনই আসলে সরকার সমন্বয় করে না। অথচ তাদের হাতে থাকা মুনাফার টাকা দিয়ে সমন্বয় করলে আর দাম বাড়াতে হতো না।'

তিনি বলেন, 'গ্যাসের দামবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তার জন্য ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এর পেছনে আছে সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি। বুঝে-শুনেই সরকার এই নীতি নিয়েছে কিছু ব্যবসায়ীকে মুনাফা দেওয়ার জন্য। দেশের ভেতরের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলন না করে অনেক বেশি দামে এলএনজি আমদানি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সবসময়ই একটা অস্থিতিশীলতা থাকে। সেই কারণে, তেল, গ্যাস ও কয়লার দামে ওঠা-নামা হয়। এই ওঠা-নামার অনিশ্চয়তার মধ্যে যাতে না পড়তে হয়, সেজন্য দরকার ছিল অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা। বাংলাদেশের সেই সম্পদ আছে। কিন্তু সেটা অনুসন্ধান না করে সরকার এলএনজি আমদানি করতে থাকল এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে থাকল। এই ২ কারণে খরচ অনেক বেড়ে গেল। এখন সেই খরচবৃদ্ধিটাকে তারা ভর্তুকি বলছে।'

জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ বলেন, 'সরকারকে ভর্তুকি দেওয়া কথা তো জনগণ বলেনি। জনগণ বলেছে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে। সেটা বাড়ালে গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান-উত্তোলন করলে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি করলে বাংলাদেশে এখন বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি কমানো সম্ভব ছিল। গ্যাসের দামও অনেক কমে যেত। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমত। তার মানে পুরো জ্বালানিখাত এমন একটা টেকসই অবস্থায় আসত, যেটার কারণে শিল্পসহ অন্যান্য খাতের উৎপাদন ব্যয়ও কমে যেত। এখন মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। শিল্পখাতে গ্যাসের দাম অনেক বেশি বাড়ানোর খাতটা একটা বড় চাপের মধ্যে পড়েছে। সরকারের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সমন্বয়ের কথা বলে তারা অবিরাম দাম আরও বাড়াতে থাকবে।'

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেছেন, প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। এ বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'তার মানে তো প্রতি মাসেই তারা দাম বাড়াতে থাকবে। প্রতিমন্ত্রীর কথায় সবসময়ই বিকৃতি থাকে। মূল বিষয়টিকে আড়াল করেন তিনি। এলএনজি-এলপিজি ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত যেসব ব্যবসায়ী, তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই আজকে বিদ্যুৎখাতের এই অবস্থা। প্রতিমন্ত্রী অনেক আগে থেকেই বলছেন, এলএনজি আমদানি করলে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। তার মানে প্রতিমন্ত্রী অনেক আগে থেকেই জানেন যে পরিণতি কী হবে। জেনে-শুনেই এমন একটা পথ সরকার গ্রহণ করেছে, যাতে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম অবিরাম বাড়ানো যায়। এর প্রধান উদ্যোক্তা বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। এখন ওই ব্যবসায়ীদের তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। চাপ বেড়ে জনগণের জীবন অসহনীয় অবস্থায় চলে যাচ্ছে।'

সমন্বয় মানে কি শুধু জনগণের কাছ থেকে বেশি অর্থ নেওয়া? জ্বালানিখাতে দুর্নীতি রোধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে আনু মুহাম্মাদ বলেন, 'জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতের পুরো সিস্টেমটাই হলো কিছু গোষ্ঠীকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া এবং দুর্নীতির একটা ক্ষেত্রকে মজবুত করা। যদি জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দক্ষ মানুষের হাতে দেওয়া হয়, তাহলে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। তার মানে আমরা যে বর্ধিত দাম দিচ্ছি, সমন্বয়ের কথা বলে যে দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেটা হলো জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে কিছু গোষ্ঠীকে দেওয়া হচ্ছে। মানে জনগণের প্রকৃত আয় কমিয়ে কিছু গোষ্ঠীকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যেটার মাধ্যম হচ্ছে সরকার, আর পরিচালক হচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী। আর সেটাকে যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্যই "সমন্বয় করছি, আমরা ভর্তুকি দিতে পারছি না"সহ নানা ধরনের কথা বলা হচ্ছে। আইএমএফও ভর্তুকি কমাতে বলেছে। কিন্তু, ভর্তুকির পেছনের কারণ বের করার কোনো কথা কেউ বলছে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

1h ago