৩৫ বছর পর লবণ পানিতে তলিয়ে গেল পাইকগাছার ১২ গ্রাম

বাঁধ ভেঙে লবণ পানি ঢুকে গেছে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ১২টি গ্রামে। মাটি দিয়ে বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা করছেন গ্রামবাসী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের মধ্যে ১২টি গত চার দিন ধরে পানির নিচে। এতে ভয়াবহ বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন গ্রামগুলোর প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা।

বাড়িঘর ছেড়ে কয়েক হাজার মানুষ এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ, পার্শ্ববর্তী উপজেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। 

কেউ কেউ বসতবাড়ি আঁকড়ে থাকলেও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ হওয়ায় এখন তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। 

তেলিখালী গ্রামে ভদ্রা নদীর বাঁধ ভেঙে লোনা পানিতে একাকার হয়ে গেছে গ্রামের সব ঘের, জলাশয়। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

শুধু গ্রামবাসীই নয়, গবাদিপশু, হাস-মুরগি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন দুর্গতরা। লোনা পানির কারণে গবাদিপশুর খাবারও নষ্ট হয়ে গেছে। রাখার জায়গা না থাকায় গরু-ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকে, রেখে আসছেন অন্য গ্রামে। পানিতে ভাসছে মরা মাছ, দুর্গন্ধে পুরো এলাকা দূষিত হচ্ছে।  

এলাকাবাসীর মতে, এর আগে সিডর, আইলা, আম্ফান, ইয়াসের মতো বড় বড় ঘূর্ণিঝড়েও তারা কখনো এমন বিপদে পড়েননি, আশ্রয়হীনও হতে হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির জন্য তারা এই দুর্ভোগে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ যদি যথাসময়ে সংস্কার করা হতো, তাহলে আর এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। 

তারা বলছেন, উপকূলীয় জেলাগুলোয় এমন মোট ৩৯টা পোল্ডার আছে, যেগুলো নদী দ্বারা বেষ্টিত জায়গা। আগে লবণ পানির চিংড়ি মাছ হতো নদীবেষ্টিত ২২ নম্বর এই পোল্ডারে। স্থানীয়দের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯০ সাল থেকে লবণ পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়। এখন সেখানে শুধু মিষ্টি পানির গলদা চিংড়ি চাষ হয়। এছাড়াও তরমুজ ও ধান চাষ হয়। 

মাছ মরে ভেসে উঠেছে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

পাইকগাছা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের একমাত্র দেলুটি ইউনিয়নের এই পোল্ডারে গত ৩৫ বছর লবণ পানি ঢোকেনি। কিন্তু এবারের ভাঙনে আর রক্ষা হয়নি। গ্রামগুলো লবণমুক্ত হতে অন্তত ৮-১০ বছর লেগে যাবে বলে জানায় গ্রামবাসী।

গোপী পাগলা গ্রামের গৃহবধূ দিপালী সরদার (৪৭) মেশিন দিয়ে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে ও হাঁস পালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। গত রোববারে বাঁধ ভেঙে তার বাড়িটি তলিয়ে যায়। হাঁসের বাচ্চা ফোটানো মেশিনটি পানিতে বিকল হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে ৬০টির বেশি হাঁস পানিতে ভেসে গেছে। বাড়ির প্রায় সব জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো রক্ষা করতে পেরেছেন, তা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে দিপালী বলেন, 'আমার সব পুঁজি শেষ হয়ে গিয়েছে। জীবিকার একমাত্র উৎস হাঁসগুলো ভেসে গেছে।'

তিনি জানান, স্বামী প্রদীপ সরকার দিনমজুর, কাজ করেন চিংড়ি ঘেরে। এবার তার কাজও বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ এলাকার সব চিংড়ি ভেসে গেছে।

গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন গ্রামবাসী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

দিপালী বলেন, 'আমি এখন পথে বসে গেলাম। ভেবেছিলাম হাঁস বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ছেলের বিএ পড়াটা কমপ্লিট করাব, কিন্তু মনে হয় আর পারলাম না।'

গত রোববারের ঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে সর্বস্ব হারিয়েছেন একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা শ্রাবন্তী সরকার ও তার স্বামী দীনবন্ধু সরকার। তারাও এখন বেড়িবাঁধে বসবাস করছেন।

শ্রাবন্তী সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোববার রাত ৩টার দিকে প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে দেখি শো শো করে পানির শব্দ হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মধ্যে খাটের সমান পানি চলে আসে। তড়িঘড়ি করে আসবাবপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়েও তা সম্ভব হয়নি।'

লবণ পানিতে একাকার দেলুটি ইউনিয়নের গ্রামগুলো। বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা করছে গ্রামবাসী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

'আমার ৩০-৩৫টা হাঁস সব ভেসে গেছে। বাড়ির আসবাবপত্র অধিকাংশই পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কোনোরকমে রাতে রাস্তায় চলে আসি। সকালের দিকে বাড়ি গিয়ে দেখি ঘর ভেঙে পড়েছে,' বলেন তিনি।

তাদের ছোট একটি গলদা চিংড়ির ঘেরও ভেসে গেছে বলে জানান তিনি।

গোপী পাগলা গ্রামে বসবাসকারী ৫৩৪ পরিবারের সবগুলোই এবারের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্তত ১০ জন গ্রামবাসী জানান, তারা এখনো কোনো আপৎকালীন সহায়তা পাননি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য শুকনো খাবারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

তবে, এই দুর্যোগের পর অনেককে দেখা গেছে অন্য এলাকা বা অন্য উপজেলা থেকে এসে দুর্গতদের খাবার দেওয়াসহ বাঁধ নির্মাণে সহায়তা করেছেন। 

ঘরবাড়ি হারিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে গ্রামবাসী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

তেমনই একজন আলী হোসেন শেখ এসেছেন বটিয়াঘাটা উপজেলার বুনোরাবাদ গ্রাম থেকে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বোনের বাড়ি এই ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামে। তাদের দুর্যোগের কথা শুনে প্রায় প্রতিদিন বাড়ি থেকে ভাত ও কিছু খাবার নিয়ে আসি। আজ এসে দেখলাম গ্রামবাসী বাঁধ নির্মাণ করছে। আমিও তাদের সঙ্গে সকাল থেকে কাজ করছি।' 

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রামচন্দ্র টিকাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চারটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেলুটি ইউনিয়নে ২২টি গ্রাম। এর মধ্যে ১২টি গ্রামই সম্পূর্ণ জলমগ্ন। কারো বাড়িতে গত চারদিন কোনো রান্নাবান্না নেই। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরা খাবার নিয়ে আসছেন। কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে আত্মীয় বাড়ি চলে গেছেন।'

'অনেক পরিবার জিনিসপত্র নিয়ে বেড়িবাঁধে অবস্থান করছেন' জানিয়ে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, 'এই এলাকার বাসিন্দারা অন্য কোথাও যোগাযোগ করতে পারছে না, কারণ গত চারদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমরা একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করছি।'

তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেলিখালী, গোপী পাগলা, ফুলবাড়ী, সেনের বেড়, হাট বাড়ি, বিগরদানা, কালিনগর, খেজুরতলা, দুর্গাপুর, সৈয়দখালি গ্রাম।

আজ বুধবার দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাক্সের ভেতর থেকে ভেজা কাপড় বের করে সড়ক ও পাশের বেড়ায় শুকাতে দিয়েছেন অনেকে। খোলা জায়গায় ফেলে রাখা খাটে শিশুরা খাবার খাচ্ছে, কেউ খেলাধুলা করছে। ট্রাঙ্ক, বাক্স, পেটরা স্তূপ করা আছে কোথাও কোথাও। 

ভদ্রা নদীর বাঁধ যেখানে ভেঙে গেছে, সেখানে অন্তত ৫-৬ হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। গ্রামের সহস্রাধিক নারীরাও পুরুষদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। 

বয়স্করা পানি ভেঙে বাড়ি থেকে জিনিসপত্র এনে বেড়িবাঁধের উপর রাখছেন। কেউ কেউ নৌকায় গবাদি পশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যাচ্ছেন। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনভারমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপিটরি রিসার্চের (সিইপিআর) চেয়ারম্যান গৌরাঙ্গ নন্দী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেলুটি ইউনিয়ন চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূখণ্ড। বিশেষ করে দেলুটি ইউনিয়নে যে অংশটি লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে সেখানে ১৯৯০ সাল থেকে কখনো লবণ পানি প্রবেশ করেনি। অনেক প্রভাবশালী এখানে লবণ পানিতে চিংড়ি চাষ করার চেষ্টা করেছে। বাঁধ কেটে লবণ পানি ঢোকানোর পাঁয়তারা করেছে। কিন্তু স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে এলাকাটি লবণমুক্ত ছিল। কিন্তু বাঁধ ভেঙে এত দিনের অর্জনটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল।'

দেলুটি ইউনিয়নটি খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ-২ এর আওতায়। যোগাযোগ করা হলে ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২২ নম্বর পোল্ডারের আয়তন প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর। ভদ্রা নদীর ২৫০ মিটারের মতো ভেঙে গিয়ে পোল্ডারটি পুরোপুরি লবণ পানিতে ভেসে গেছে। সাধারণত পোল্ডারের যেকোনো একপাশ ভাঙলে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। ভাঙন এলাকায় রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।'

আজ এলাকাবাসীর বাঁধ নির্মাণের সময় দেলুটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডল সেখানে যান। তারপর তিনি ফটোসেশন এবং ভিডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন, বাঁধটি তার নেতৃত্বে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কথা শুনে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী তার ওপর আক্রমণ করে এবং কাদামাটিসহ ইটের টুকরো ছুঁড়ে তাকে নাজেহাল করে। পরে তাকে ট্রলারে উঠিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ইউপি চেয়ারম্যান রিপনকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

পরে দুপুরে খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আজ ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যান। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী মন্ত্রীর কাছে জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অবহেলার কথা তুলে ধরেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Fishermen lost at sea: Authorities install plaque while families await aid

At least 188 fishermen have gone missing in the past three decades in Barguna's Patharghata upazila

1h ago