৩৯ মৃত হরিণ উদ্ধার, সুন্দরবনে উদ্ভিদের চেয়ে প্রাণীর ক্ষতি হয়েছে বেশি

ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে গাছ পড়ে গেছে, হরিণ মারা গেছে সুন্দরবনে। ছবি: সংগৃহীত

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত সামলে নিয়েছে সুন্দরবন। কিন্তু উঁচু জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি নিজেকে।

সুন্দরবনে এত উঁচু জলোচ্ছ্বাস সাম্প্রতিক সময়ে দেখেননি স্থানীয়রা। লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে বনের স্বাদু পানির ৮০টি বড় পুকুরসহ শতাধিক পুকুর। 

অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান থেকে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৯টি মৃত হরিণ, একটি মৃত বন্য শুকর ও আহত ১৭টি হরিণ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। 

গত রোববার বিকেলে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হড্ডা গ্রামের কয়রা নদীতে ভেসে আসে একটি হরিণ শাবক। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় বনরক্ষীরা হরিণ শাবকটিকে নিয়ে বনের টহল ফাঁড়ির পুকুরের উঁচু পাড়ে ছেড়ে আসেন।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার স্টেশনের আওতাধীন বনের ভেতরে কয়রা টহল ফাঁড়ির মিঠা পানির পুকুরটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় উঁচু জোয়ারে নোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবনে অবস্থান করা বনকর্মী, জেলে-বাওয়ালি, মৌয়াল ছাড়াও বন্য প্রাণীগুলো এই পুকুরের পানি পান করে।

সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশ কয়েকটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছি। কিন্তু এত বেশি পানি আগে কখনো দেখিনি। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত ৫-৭ ফুট পানি বেশি হয়েছিল করমজলে।'

সাগর উপকূলে দুবলা, কটকা, কচিখালী এলাকায় পানি আরও কয়েক ফুট বেশি হয়েছিল বলে জানান তিনি। 

জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে করমজল প্রজনন কেন্দ্রের কুমির-কচ্ছপসহ প্রাণীদের কোনো ক্ষতি হয়নি জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, 'বনের মাঝে প্রাণীদের জন্য বেশ কিছু উঁচু স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এই টাইগার টিলাগুলোতে কিছু প্রাণী আশ্রয় নিতে পেরেছে।'

সুন্দরবনের কটকায় বন বিভাগের একটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে। ছবি: সংগৃহীত

বন বিভাগ বলছে, রিমাল পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩৯টি মৃত হরিণ, একটি মৃত বন্য শুকর ও অসুস্থ ১৭টি হরিণ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। 

এছাড়া, সমুদ্র–তীরবর্তী দুবলার চর ও কটকা বন বিভাগের কার্যালয়ের জেটি স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বনকর্মীদের থাকার ঘরের জানালার কাঁচ, সুপেয় পানির ট্যাংক, সোলার প্যানেল উড়ে গেছে বাতাসে। 

তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের তোড়ে বনের কটকা এলাকার পুকুরটি বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে।

জানা গেছে, মিষ্টি পানির আধার হিসেবে সুন্দরবনে রয়েছে ১১৫টি পুকুর। এর মধ্যে শুধু বিভিন্ন প্রাণীর জন্য ছোট আকারের পুকুর ৩৫টি। আর মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য ৮০টি পুকুর আছে। সবগুলো পুকুর লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঝড়ের তীব্রতা যেমন ঠেকিয়েছে সুন্দরবন, তেমনি অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের গতিও মন্থর করেছে সুন্দরবন। তবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিষ্টি ও লবণ পানির যে মিথস্ক্রিয়া তা নষ্ট হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে লবণ পানি ঢুকেছে যা বনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করবে।'

জানতে চাইলে খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, 'সুন্দরবনে যে ক্ষতি হয়েছে সেখানে আমার মনে হয়েছে উদ্ভিদের তুলনায় প্রাণীকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। সিডরের সময় যেমন বেশি গাছপালা পড়ে গিয়েছিল, তখন প্রাণীকুলের অতটা ক্ষতি হয়নি। ২৬ তারিখ সকাল থেকে সুন্দরবন প্লাবিত হয়েছে। কোথাও ৮-১০ ফিট, কোথাও কোথাও তারও বেশি জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে সুন্দরবনের অধিকাংশ জায়গা। বিশেষ করে মান্দারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী অধিক জোয়ারে ভেসেছে।'

তিনি আরও বলেন, '৩৬ ঘণ্টা পর বন থেকে পানি নেমেছে। পানি নামার গতি এবং তীব্র জলোচ্ছ্বাসে সাধারণ প্রাণীকুল ভেসে যাওয়া স্বাভাবিক।'

'কাজেই এই দীর্ঘ সময়ে বাঘ শাবক, হরিণ শাবক এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীরও বেঁচে থাকা কঠিন। কারণ কোথাও উঁচু জায়গা ছিল না,' বলেন তিনি।

বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো আরও বলেন, 'একইসঙ্গে মিষ্টি পানির যে প্রায় ১০০ পুকুর ছিল, যেখান থেকে বন্যপ্রাণী, বনজীবী, বনকর্মীরা পানি সংগ্রহ করত সব ডুবে গেছে, লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে প্রাণীদের পানির সংস্থান একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।'

'আমরা সব আইডেন্টিফাই করতে পারব না ঠিক কী পরিমাণের ক্ষতি হয়েছে। তবে এই ক্ষতির কথা সরকারকে জানাব। কিছুদিন আগে একটি সার্ভে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আরও একটি সার্ভে হওয়া দরকার প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram’s garment factories fear fallout from US tariffs

Owners of Chattogram-based readymade garment factories, many of which do business with buyers in the United States, are worried about a US tariff hike to 35 percent set to take effect on August 1.

12h ago