বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার ছাড়ছেন কেন?
দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকট, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান সুদ ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে সূচক ক্রমাগত পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত বাজার ছাড়ছেন।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা এক বছর আগের তুলনায় চার শতাংশেরও বেশি কমে ১৭ লাখ ৯০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
এক বছর আগে, বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৭১ হাজার। এটি ২০২২ সালের মে মাসে ছিল ২০ লাখ ৮০ হাজার। এর আগের বছরে একই মাসে ছিল ২৬ দশমিক ৬১ হাজার।
যদিও বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রকৃত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা জানা যায় না। তবে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে সংখ্যাটি এখনো নগণ্য।
পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন সুশাসনের অভাব, ভালো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম, ব্যাংকিং খাতে দ্রুত সুদের হার বাড়ানো ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে এই পতন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুঃখজনক হলো, ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনলেও ভালো মুনাফা হবে তা নিশ্চিত বলা যায় না। উপরন্তু খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগ করলে বেশি মুনাফা হচ্ছে। তাই সচেতন বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছেড়ে দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। অনেকে শেয়ার বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন। আরও অনেকে হয়ত শিগগির চলে যাবেন।
প্রায় তিন দশক ধরে পুঁজিবাজারে থাকা এক বাজার বিশ্লেষক গত সপ্তাহে ডেইলি স্টারকে জানান, পরিস্থিতির আরও খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
তার এমন উদ্বেগের পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।
মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘদিন ধরেই হিমশিম খাচ্ছে অর্থনীতি।
২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। গত দুই বছরে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩৫ শতাংশ। আমদানি হয়েছে ব্যয়বহুল।
টাকার দাম আরও কমলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও শেয়ার বিক্রি করবেন বলে জানান এই বিনিয়োগকারী। একইভাবে আগামীতে ডলারের রিজার্ভ না বাড়লে উৎপাদন খাত সমস্যায় পড়তে পারে।
'কারণ, কাঁচামালের দাম বাড়বে। টাকার দাম দ্রুত কমায় বছরের এই প্রান্তিকে ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমে যেতে পারে,' বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
বিনিয়োগকারী জাকির হোসেন গত মাসে তার সব শেয়ার বিক্রি করে বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত তিন বছরে আমার বিনিয়োগের ৬০ শতাংশ হারিয়েছি। ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রায় দুই বছর আটকে ছিলাম। গত বছরের শুরুর দিকে যখন টাকার খুব দরকার হয় তখন শেয়ার বিক্রি করতে পারিনি।'
গত জানুয়ারিতে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া শুরুর আগে প্রায় দুই বছর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছয় হাজার ২০০ পয়েন্টের আশেপাশে ছিল। এরপর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত তা ১১ শতাংশ বা ৭২৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৫১৭ পয়েন্ট।
দেশের বিনিয়োগকারীরা এমন সময়ে শেয়ারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন যখন অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজার চাঙা হচ্ছে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ৩০টি বড় প্রতিষ্ঠানের সূচক গত শুক্রবার প্রথমবারের মতো ৪০ হাজার পয়েন্ট হয়।
গত মার্চে সংকটে থাকা অর্থনীতির মধ্যে জার্মানির বেঞ্চমার্ক ব্লু-চিপ স্টক ইনডেক্স প্রথমবারের মতো ১৮ হাজার পয়েন্টে পৌঁছায়।
বাহ্যিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিফটি ৫০ ও ভারতের বিএসই সেনসেক্স রেকর্ড করেছে। ২০২৩ সালকে ২০১৭ সালের পর দ্বিতীয় সেরা বছর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
গত সোমবার পাকিস্তানের বেঞ্চমার্ক সূচক ৭১ হাজার ৪৭৪ পয়েন্টের রেকর্ড উচ্চতায় লেনদেন করে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে এই বাজার ৭৪ শতাংশ বেড়েছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভালো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে সাধারণত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির শিকার হন না।'
তিনি আরও বলেন, 'যদিও বেশিরভাগ ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে তারা ভবিষ্যতে আরও বেশি মুনাফা দিতে পারে। তাই বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে।'
তিনি মনে করেন, 'ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বাড়ানোয় তা পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলেছে।'
মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) প্রবর্তন ও ঋণের নয় শতাংশ সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে স্মার্ট ব্যবস্থা বাতিল করে।
এটি বিলুপ্ত হওয়ার আগেও ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত তিন বছর ধরে চলা ঊর্ধ্বসীমার তুলনায় এটি অনেক বেশি। ট্রেজারি বিলের সুদের হার রেকর্ড ১২ শতাংশে পৌঁছেছে।
মানুষ বেশি মুনাফা পেতে ব্যাংকে টাকা রাখছেন। যদিও ট্রেজারি বন্ড থেকে প্রচুর মুনাফা আসছে।
মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আরও বলেন, 'বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পুঁজিবাজারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু, বাস্তবে এসব কিছু দেখা যাচ্ছে না।'
'বাজারে কেনার মতো শেয়ারের সংখ্যা অনেক থাকা উচিত। গ্রামীণফোনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে পারে। তারা গত এক দশক পুঁজিবাজারে আসেনি।'
তার মতে, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট গভর্নেন্স ও বিশ্বস্ততা থাকতে হবে। তবে দেশের বাস্তবতা হলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
আশির দশক থেকে ডিএসইতে শেয়ার লেনদেন করে আসা সারোয়ার আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সব সময় ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনেছি। গত ৪০ বছরে বাজারের অনেক উত্থান-পতন দেখেছি।'
২০১১ সালে পুঁজিবাজারে ধস নামার আগেই তিনি বাজার ছেড়েছেন। তাই লোকসানে পড়েননি। তবে, গত দুই বছরে তিনি তার শেয়ারগুলোর দাম প্রায় ৪০ শতাংশ হারিয়েছেন।
বাজারের উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি বিনিয়োগ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। তার মন্তব্য, 'এটা হতাশাজনক।'
Comments