পুঁজিবাজারে ফিরছে বিদেশি বিনিয়োগ

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে এবং ফ্লোর প্রাইসসহ বাজারে হস্তক্ষেপ করা যায় এমন কোনো ব্যবস্থা পুনরায় আরোপ করা হবে না।
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

দীর্ঘদিন পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনতে আবার আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছেন। কারণ তারা আশা করছেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের শেয়ারবাজারে সুশাসন ফিরে আসবে।

এর আগে, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ টানতে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে।

এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে এবং ফ্লোর প্রাইসসহ বাজারে হস্তক্ষেপ করা যায় এমন কোনো ব্যবস্থা পুনরায় আরোপ করা হবে না।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ার আরেকটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার কমেছে এবং বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির শেয়ারের মূল্য অনেক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩০ লাখ ডলার।

ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত পাশা বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে সুশাসন।'

'প্রতারকদের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে তারা খুবই ইতিবাচক,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো মুনাফা।

তার ভাষ্য, 'বিদেশি মুদ্রা বাজার অস্থিতিশীল হলে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়, এতে তাদের বিনিয়োগ মূল্য কমে যায়। তাই সাম্প্রতিক সংস্কার কার্যক্রম বিদেশি মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা আনবে বলে তাদের আশা।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪০ শতাংশের বেশি।

এদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নেট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ গত চার অর্থবছরে নেগেটিভ ছিল, ২০২৪ অর্থবছর তারা ৬২ মিলিয়ন ডলার সম পরিমাণ বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যায়। ২০২৩ অর্থবছরে তারা ৩০ মিলিয়ন ডলার তুলে নিয়ে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২০২১ অর্থবছর থেকে বিপুল হারে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করে, তখন তারা ২৬৯ মিলিয়ন ডলারের শেয়ার বিক্রি করে নিয়ে যায়। অবশ্য ২০২২ অর্থবছরে তা কমে ১৫৮ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগে যেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, এখনো সেগুলোই তাদের প্রথম পছন্দ। কারণ তারা মনে করেন, এসব শেয়ার থেকে নিশ্চিত মুনাফা পাওয়া যাবে। আরেকটি কারণ হলো, গত চার বছরে নতুন কোনো ভালো শেয়ার তালিকাভুক্ত হয়নি, তাই তাদের হাতে অন্য বিকল্প নেই।

ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ জানিয়েছে, জুলাই থেকে মূলত ভালো পারফর্ম করা শেয়ারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্রয় আদেশ বেড়েছে।

সিটি ব্যাংক ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদ হোসেন বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বেশি অংশগ্রহণের মূল কারণ ভালো শেয়ারের দাম তুলনামূলকভাবে কম।'

তিনি আরও বলেন, 'এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের সুদের হার কমছে, তাই সেখানকার বিনিয়োগকারীরা উদীয়মান বাজারগুলোতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে, বাংলাদেশও সেই তালিকায় আছে।'

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে চার বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো সুদের হার কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফেডারেল রিজার্ভ মূল ঋণের হারের লক্ষ্যমাত্রা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে চার দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

'আওয়ামী লীগ সরকারের পতন বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়েছে,' মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'এ কারণে তাদের (বিদেশি বিনিয়োগকারী) অনেকেই এখন তালিকাবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানেও বিনিয়োগের কথা ভাবছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে বাজারে আস্থা বাড়াতে সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে।'

তার ভাষ্য, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণসহ অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিল, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল শেয়ারবাজারে। কিন্তু এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের নীতি বাস্তবায়ন করা হবে না, এর পরিবর্তে শেয়ারবাজারে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে।

একই সঙ্গে শেয়ারের কারসাজিও কমে আসবে। তাই তারা বাজারে অর্থ বিনিয়োগ শুরু করেছে।

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মার্কেট অ্যানালিটিক অ্যান্ড ইনডেক্স প্রোভাইডার এফটিএসই রাসেল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের উপস্থিতি যাচাই করতে গত মাস থেকে পুনরায় স্থানীয় শেয়ারগুলোর পর্যালোচনা শুরু করেছে।

ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পর্যালোচনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সাধারণত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভালো শেয়ার চিহ্নিত করতে বেশ কিছু সূচক দেখে। যার মধ্যে একটি সূচক হলো এফটিএসই, যেখানে ২৫টি বাংলাদেশি শেয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মোহাম্মদ রহমত পাশা ও এরশাদ হোসেন দুজনেই সুশাসন নিশ্চিত করা ও বাজারে বেশি বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ভালো শেয়ার তালিকাভুক্তির ওপর জোর দেন। তারা মনে করেন, বাজারবান্ধব নীতি নিশ্চিত করতে হবে এবং তা ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত হবে না।

Comments