নতুন বছরে যে ৩ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে শেয়ারবাজার
সদ্য বিদায় নিলো ২০২৩ সাল। তবে, বিদায়ী বছরে অনেক পুরোনো অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। ভালো করতে পারেনি শেয়ারবাজারও।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ফ্লোর প্রাইসসহ একাধিক কারণে শেয়ারবাজার হতাশাজনক একটি বছর পার করেছে।
নতুন বছরেও দেশের শেয়ারবাজার রাজনৈতিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জে পড়বে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে উচ্চ সুদহার বিষয়ক সমস্যা।
যেমন- আমানতের সুদহার বাড়তে পারে, ফলে বিনিয়োগকারী ও সঞ্চয়কারীরা বেশি লাভের জন্য পুঁজিবাজারের তুলনায় ব্যাংকে অর্থ জমাতে আগ্রহী হবে।
তাই আপাতদৃষ্টিতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বড় কোনো উন্নতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বিদায়ী বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বেশিরভাগ শেয়ারের দর ফ্লোর প্রাইসের কারণে নজিরবিহীনভাবে অপরিবর্তিত ছিল। যা বিনিয়োগকারী, ব্রোকার, সম্পদ ব্যবস্থাপক ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদের আস্থা কমিয়েছে।
এছাড়া পুরো বছর ধরে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপও বিনিয়োগকারীদের ওপর প্রভাবে ফেলেছে।
ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের শেষে মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বা ৪০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২৪৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
গত এক বছর ধরে শেয়ারবাজারের এই দুর্দশার মূলে ছিল যুদ্ধ, জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, টাকার অবমূল্যায়ন এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সৃষ্ট সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
এই চ্যালেঞ্জগুলো ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে এসব চ্যালেঞ্জের পেছনের কারণগুলোর কোনো পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত।
শেয়ারবাজারের এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যোগ হতে পারে উচ্চ ব্যাংক সুদহার ও ট্রেজারি বিলের হার।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সূচকের পতন রোধে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে। তাদের এই সিদ্ধান্তে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়।
সুতরাং ২০২৪ সালে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে কিনা তা নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর। এগুলো হলো- ফ্লোর প্রাইস, সুদহার ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বৃদ্ধি, এফডিআর হার বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকায় ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর তেমন সম্ভাবনা নেই।'
তিনি জানান, ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ইতোমধ্যে ১১ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এই হার আরও বাড়তে পারে, কারণ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নেওয়ায় চেষ্টা করবে। বিকল্প হিসেবে বন্ড বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করবে সরকার।
আর বন্ড ও ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্টের (এফডিআর) সুদহার বাড়লে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে অর্থ রাখতে আগ্রহী হয়। এতে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ ব্যাংকিং খাতের দিকে প্রবাহিত হবে।
এই অ্যাসেট ম্যানেজার বলছেন, সরকার টাকার বিনিময়ে ব্যাংক থেকে মার্কিন ডলার কিনে অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ বাড়াচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে। যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখন এফডিআর ও ট্রেজারি বন্ডের সুদহারও বাড়ে। সুতরাং, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তেমন দেখা যাচ্ছে না।
'কারণ কোনো বিনিয়োগকারী যদি ট্রেজারি বন্ডে টাকা রেখে ১১ শতাংশের বেশি সুদ পান, তাহলে তিনি শেয়ারবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কেন বিনিয়োগ করবেন,' বলেন তিনি।
এদিকে ব্যাংকের সুদহারও বাড়তে পারে।
বর্তমান বেঞ্চমার্ক ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড় হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা স্মার্ট রেট হিসেবে পরিচিত। সুতরাং ব্যাংকগুলো ঋণের জন্য ১২ শতাংশ সুদ নিতে নিতে পারে। যদিও ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জুন এই সুদহার ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল।
ঋণের সুদহার বাড়লে আমানতের সুদের হার তার চেয়ে বেশি হবে। এতে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ ব্যাংকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন থেকেও একটি ধাক্কা আসতে পারে। কারণ স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ নিষ্পত্তির চেষ্টা করে।
গত দুই বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে, নতুন বছরেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
সন্ধানী অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর আরিফুল ইসলাম বলেন, 'ফ্লোর প্রাইস যতদিন থাকবে ততদিন শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী কাজ করবে না। তবে ফ্লোর প্রাইজ তুলে নেওয়া হলে প্রাথমিকভাবে সূচকের পতন হতে পারে আবারও বাড়তেও পারে।'
তিনি মনে করেন, নতুন সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করে বাজারে একটি নতুন আশা জাগিয়ে তুলতে পারে।
'সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়ালে শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার উল্লেখ করেন, যদিও শেয়ারবাজারের ভাগ্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে, তবুও সরকার দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য নীতির সংস্কার করেনি।
আবার বিদায়ী বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পারফরমেন্স আশাব্যঞ্জক ছিল না, এ কারণেও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়েছেন।
২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে অনেক কোম্পানির মুনাফা কমেছে। এ বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মজুরি ও কাঁচামালের দামের কারণে মুনাফা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
যা শেষ পর্যন্ত সূচকে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন এই মার্চেন্ট ব্যাংকার।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী আবদুল মান্নান বলেন, 'ফ্লোর প্রাইস তুলে না নেওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে না।'
তিনি আরও বলেন, 'ক্রেতার অভাবে গত দেড় বছরে আমি কম সংখ্যক শেয়ার লেনদেন করতে পেরেছি। অথচ ছয় মাস আগে আমার শেয়ার বিক্রি করা খুব প্রয়োজন ছিল।'
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে দেশের প্রধান শেয়ারবাজারে লেনদেন করা ৩৪৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮২টির দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল।
আবদুল মান্নান বলেন, 'কিছু বিনিয়োগকারী গুজবে কান দিয়ে লাভবান হয়েছে, অথচ সৎ বিনিয়োগকারীরা অলস বসে আছেন। আমি ২০২৪ সালে একই চিত্র দেখতে চাই না।'
গত এক বছরে ১৪টি বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার ১ শতাংশ ও ১০টি বড় ব্লু-চিপ কোম্পানির শেয়ারের দর শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এ থেকে বোঝা যায় ২০২৩ সালে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর অবস্থা ভালো ছিল না।
অন্যদিকে, শীর্ষ ১০টি গেইনারের মধ্যে নয়টি 'বি' ক্যাটাগরি বা 'জেড' ক্যাটাগরির ছিল। যদিও এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল আয়ের কারণে শেয়ারহোল্ডারদের ন্যূনতম লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
নয়টি কোম্পানির মধ্যে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের শেয়ার সাত গুণ ও লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ার তিনগুণ বেড়েছে। বাকিদের দ্বিগুণের বেশি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা আশা করি, নতুন সরকার বাজারে সুশাসন নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করবে, যেন মন্দ কোম্পানির শেয়ার আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে।'
তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইস কেবল ব্রোকারদের ব্যবসাকে চাপে ফেলেনি, টার্নওভার কমায় স্টক এক্সচেঞ্জও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
২০২২ সালে ডিএসইতে প্রতিদিনের গড় টার্নওভার ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ কমে ৫৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ২০২২ সালে কমেছিল ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
সাইফুল ইসলাম মনে করেন, ফ্লোর প্রাইস নিয়ে বাজারে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা নতুন সরকার দূর করবে।
'নতুন সরকারকে অবশ্যই সূচকের ওপরে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে চিন্তা না করে দ্রুত ফ্লোর প্রাইস তুলে নিতে হবে। তারপর ভালো পারফর্ম করা কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হবে।'
তিনি বলেন, 'বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য ভালো কোম্পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে।'
(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রবিউল কমল)
Comments