শেয়ারবাজারে আটকে আছে ব্যাংকগুলোর ১৬ হাজার কোটি টাকা

শেয়ারবাজারে আটকে আছে ব্যাংকগুলোর ১৬ হাজার কোটি টাকা
ছবি: স্টার গ্রাফিক্স

গত এক বছর ধরে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ আটকে আছে।

২০২১ সালে করোনা মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ারের ব্যাপক পতন রোধে শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে। ফ্লোর প্রাইস হলো একটি শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম এবং সেই দাম থেকে আর কমতে পারবে না। তবে, গত ডিসেম্বরে ১৬৯টি কোম্পানির জন্য ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও বাড়লে চলতি বছরের মার্চে আবার চালু করা হয়।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৫৩টি ব্যাংক শেয়ারবাজারে ১৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, যা আগের বছর ছিল ১৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা।

এই বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকগুলো কোনো মূলধনী লাভ পায়নি। কারণ, এসব শেয়ার বেচাকেনা করা সম্ভব হয়নি। তাদের একমাত্র সান্ত্বনা এসেছে লভ্যাংশ থেকে, যা এক বছর আগের সঙ্গে তুলনা করা হলে মানে ২০২২ সালেও একইরকম ছিল।

একজন ব্যাংকার বলেন, 'ফ্লোর প্রাইস আমাদের কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমী) আলী বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে না, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সরকার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছিল। যেহেতু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে, তাই একটি সঠিক গাইডলাইন থাকা উচিত।

এই ব্যাংকার মনে করেন, ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়, বরং তাদের উচিত উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া।

স্থানীয় সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থাকলেও, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই হার বেশি।

গত বছর ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক শেয়ারবাজারে ৫ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, যা ব্যাংকিং খাতের মোট বিনিয়োগের ৩৬ শতাংশ।

২০২২ সালে ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে সোনালী ব্যাংক, যার পরিমাণ ২ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে জনতা ব্যাংক, যার পরিমাণ ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল ৮৬৮ কোটি টাকা, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।

প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, '২০২২ সালে শেয়ারবাজারে মন্দার কারণে পোর্টফোলিও ভারসাম্য ধরে রাখা ও মূলধনী লাভের কোনো সুযোগ ছিল না।'

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো গত বছর তাদের বিনিয়োগের লভ্যাংশ থেকে আয় করেছে।

একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো যদি দেখে শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগ আটকে যেতে পারে, তাহলে তারা আর বিনিয়োগ করবে না। এটি বাজারে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এর মধ্যে অনেক ব্যাংকের শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ আয় কমেছে। যেমন- সোনালী ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আয় ৮৬ শতাংশ কমে ৭২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের আয় ৯৯ শতাংশ কমে ১ কোটি টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের আয় ৭১ শতাংশ কমে ১০ কোটি টাকা হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর কম আয় মানে বিনিয়োগকারীদের জন্য কম লভ্যাংশ। যেমন- সিটি ব্যাংক ২০২২ সালের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা ২০২১ সালে ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া, আরও অনেক ব্যাংকের লভ্যাংশ কমেছে।

একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার বলেন, ফ্লোর প্রাইস বিশ্বের বেশিরভাগ শেয়ারবাজারে প্রায় নজিরবিহীন। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হলে বিদেশিসহ অনেক বিনিয়োগকারী বিক্রি করে দেবে, ফলে বাজার নিম্নমুখী হবে। তবুও, বাজার শেষ পর্যন্ত অন্যান্য দেশের মতো ঘুরে দাঁড়াবে।

মনিরুজ্জামান বলেন, এমনকি ব্লু-চিপ শেয়ারের চাহিদাও নেই, কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিত্তশালীরা বাজারে প্রচুর পরিমাণে তহবিল নিয়ে আসছেন না।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন ফ্লোর প্রাইসকে সীমাবদ্ধতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

তিনি মন্তব্য করেন, শেয়ারবাজারে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আশা করা যায় না।

তিনি বলেন, এই বিধিনিষেধ বাজারকে প্রায় অচল করে ফেলেছে এবং এ থেকে কোনো পক্ষ উপকৃত হচ্ছে না।

তিনি বলেন, কৃত্রিম মূল্য কারো জন্য লাভজনক হতে পারে না। আমরা বিএসইসিকে দ্রুত ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকার থেকে শুরু করে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাসহ শেয়ারহোল্ডাররা দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইসের বিরোধিতা করে আসছেন। কারণ এতে তাদের ব্যবসা মারাত্মভাবে প্রভাবিত হয়েছে।

তবে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম গত মাসে বলেছিলেন, অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেবে।

মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই এই সমস্যা শিগগির শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না।

তার মানে ব্যাংকগুলোর তহবিলের বড় একটি অংশ আগামী মাসগুলোতেও শেয়ারবাজারে আটকে থাকতে পারে, যা মূলত আমানতকারীদের অর্থ।

 

Comments

The Daily Star  | English
 Al Bakhera killings Al Bakhera killings

Killings in Chandpur: Water transport workers go on strike

Water transport workers has started an indefinite strike from midnight

1h ago