আর্থিক বিবরণী দিচ্ছে না ১০ প্রতিষ্ঠান, ধোঁয়াশায় বিনিয়োগকারীরা

শেয়ারবাজার, পুঁজিবাজার, এনবিএফআই, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বে লিজিং, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি,

এক এক করে কেটে গেছে সাত মাস। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) প্রায় অর্ধেকের আর্থিক বিবরণী এখনো পাওয়া যায়নি।

ফলে পুঁজিবাজারে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর গত বছরের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ধোঁয়াশায় আছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, অন্তত ১৪টি আার্থিক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গিয়েছে।

নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থবছর জানুয়ারিতে শুরু হয়ে চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিধিমালা অনুসারে, মিউচুয়াল ফান্ড ছাড়া তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক আর্থিক বিবরণী অর্থবছর শেষ হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে অডিট করতে হয়।

নিয়ম অনুসারে, অডিটের ১৪ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। অর্থাৎ, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মে মাসের মাঝামাঝি তাদের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করতে বাধ্য।

বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২৩টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত আছে। এর মধ্যে ১০ প্রতিষ্ঠান এখনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি।

প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—বে লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, এফএএস ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ও উত্তরা ফাইন্যান্স।

যে ১৩ প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তারা ২০২৩ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।

১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রথম ২ ত্রৈমাসিকের আর্থিক বিবরণীও প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ না করলে বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে থাকেন।'

তিনি আরও বলেন, 'এসব প্রতিষ্ঠানের সময়মতো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত। তাদের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ-ভালো যাই হোক না কেন বা তারা অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ বা অনেক ক্ষতির মুখে পড়লেও তা প্রকাশ করা উচিত।'

এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিএসইসির প্রতি আহ্বান জানিয়ে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, 'প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানার অধিকার বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই আছে।'

অনিয়ম বা লোকসানে থাকা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক বিবরণী দাখিলের ক্ষেত্রে গড়িমসি করতে দেখা যায়।

আর্থিক বিবরণী না দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জিএসপি ফাইন্যান্সের হালনাগাদ তথ্যে মুনাফার কথা জানা যায়। তবে বাকিগুলো লোকসানে আছে বলে ডিএসইর তথ্যে দেখা গেছে।

আর্থিক বিবরণী প্রকাশ না করা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বিশাল অঙ্কের খেলাপির পাশাপাশি আর্থিক অনিয়মে জর্জরিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা মোট বকেয়ার প্রায় এক চতুর্থাংশ।

আর্থিক বিবরণী না দেওয়া ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু ইউনিয়ন ক্যাপিটাল আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ২০২২ সালের আর্থিক বিবরণী প্রকাশে দেরির কারণ দেখিয়েছে।

ইউনিক্যাপ ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ আদায়ের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।

ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এর সহ-প্রতিষ্ঠান ইউনিক্যাপ ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডকে ঋণ দিয়েছে। তবে, সহ-প্রতিষ্ঠানটি মার্জিন ঋণের ওপর সুদ নিতে পারছে না। কারণ, তাদের বেশিরভাগ গ্রাহক শেয়ারবজারে দরপতনের কারণে ক্ষতির মুখে রয়েছে।

সুতরাং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল যদি এর সহ-প্রতিষ্ঠানটির ওপর সুদ আরোপ করে তবে সেটি যথেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে।

যেহেতু বিষয়টির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, তাই ইউনিয়ন ক্যাপিটাল তাদের ২০২২ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী চূড়ান্ত করার মতো পরিস্থিতিতে নেই।

ইউনিয়ন ক্যাপিটালের কোম্পানি সচিব আব্দুল হান্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত পেয়েছি। তাই বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।'

গত মার্চে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের খেলাপি ছিল ৫৯৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা, উত্তরা ফাইন্যান্সের ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, পিপলস লিজিংয়ের ৯০৭ কোটি টাকা, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ৯৬৭ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির ৭৫৫ কোটি টাকা খেলাপি আছে।

পিপলস লিজিংয়ের সচিব আরমিয়া ফকির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাইকোর্ট আমাদের প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের নির্দেশ দিয়েছিল।'

পরে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবসা শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়। গত ৩ বছরে বেশ কয়েকবার এর বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে।

'প্রতিষ্ঠানটির অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি,' বলে মন্তব্য করেন আরমিয়া ফকির।

এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের কোম্পানি সচিব জাহিদ মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অডিট কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা যায়নি।'

ফারইস্ট ফাইন্যান্সের সচিব রমজান হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষণ করে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে।'

শিগগির প্রতিবেদনটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।

বিএসইসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, বেশিরভাগ নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়িয়ে নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, 'অন্যদিকে, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রচুর খেলাপি ও লোকসান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আমরা এই দ্রুত শেষ করার তাগাদা দিচ্ছি।'

প্রিমিয়ার লিজিংয়ের সচিব সুভাষ চন্দ্র মল্লিক ও প্রাইম ফাইন্যান্সের সচিব মোহাম্মদ জামান ডেইলি স্টারকে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অডিট করতে দেরি করেছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সায়েদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিনিয়োগকারীরা জানেন যে বেশিরভাগ নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান খেলাপির কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। তবে তারা আর্থিক বিবরণী দেখে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে চান।'

তার মতে, 'যদি প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করে তবে বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে থাকেন। তারা পরবর্তী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়েন।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

26m ago