ডিম, আলু, পেঁয়াজের দাম বেঁধে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব

ডিম, আলু, পেঁয়াজ, নিত্যপণ্য মূল্য, মূল্যস্ফীতি,
প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা জিনিসপত্রের উচ্চ দাম দেশের কম ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের বিপাকে ফেলেছে। এটি তাদের ক্রয় ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের মতো কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার।

অর্থনীতিবিদরা সাধারণত পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার বিরোধিতা করেন। কেননা, এধরনের উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত দাম অনুসরণ করা হয় না। তাই মানুষের ভোগান্তিও কমে না।

রাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মউজেরই দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পণ্যের দাম সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত নয়। বরং পণ্যের সরবরাহ সংক্রান্ত বাধাগুলো দূর করতে হবে, যাতে বাজার নিজস্ব গতিতে চলতে পারে। কোনও বিশেষ গোষ্ঠী যেন বাজারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।'

তার যুক্তি, বাজার অর্থনীতিতে সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলে তা সাধারণত কার্যকর হয় না। তিনি বলেন, 'তাছাড়া চাহিদা ও সরবরাহ ভিত্তিক দাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি সমস্যা সৃষ্টি করে।'

অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি আরও বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানি নির্ভর। তাই ডলারের বিপরীতে টাকার উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।'

উচ্চমাত্রার আমদানি বিলের কারণে রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত দেড় বছরে টাকার দাম প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে।

তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে টাকাকে শক্তিশালী রাখায় অর্থনীতিতে এর প্রভাব দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে।

'যদি টাকার দাম আরও কমে যায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে,' যোগ করেন অর্থনীতিবিদ মুজেরি।

তিনি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচককে শক্তিশালী করতে সহায়ক নীতি গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় গত আগস্টে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ২৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৯২ শতাংশে। আগের মাসে এটি ছিল নয় দশমিক ৭৬ শতাংশ।

'মূল্যস্ফীতির হার কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ এটি কেবল চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে' উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ মুজেরি আরও বলেন, 'শুধু চাহিদার কারণেই দাম বাড়ে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয় মূলত সরবরাহে বাধার কারণে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ায়। বাজারের এই দুর্বলতা দূর করতে হবে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো ও বাজার পর্যবেক্ষণ উন্নত করতে সরকারের দৃঢ় সদিচ্ছা থাকা উচিত।'

তিনি আরও বলেন, 'অর্থনৈতিক সূচক নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা নেই। তাই সরকার হঠাৎ করে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'

তাঁর মতে, পণ্য আমদানি কোনো সমাধান নয়। সরবরাহ ঘাটতির পরিবর্তে সমস্যাগুলো বাজার ব্যবস্থায় দেখা যায়। বাজারে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজির কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমন পরিস্থিতির কারণ ও সমাধান জানা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিগত নিষ্ক্রিয়তার কারণে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে।'

রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সরকারকে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপিয়েছে বলেই মূল্যস্ফীতি বেশি। রিজার্ভ কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার নীতি ৫০ বছরের পুরনো। এটি কাজে না আসায় বিশ্বব্যাপী এ নীতি বাতিল করা হয়েছে।'

তিনিও মনে করেন, সরবরাহ ও চাহিদার অসামঞ্জস্যতার কারণে নয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশের কারণে কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এভাবে দাম বেধে দিলে বাজার মনিটরিং টিমের সামনে তাৎক্ষণিকভাবে দাম কমতে পারে। তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে পণ্য বা বিক্রেতা উভয়ই বাজার থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে। তাই তা হিতে বিপরীতও হতে পারে।'

তিনি বলেন, 'সরকারের উচিত এই কারসাজি দূর করা এবং বাজারে প্রতিযোগিতার নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা।'

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডিম, আলু ও পেঁয়াজের খুচরা দাম নির্ধারণ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব পণ্য বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের একজন মুদি দোকানী ফিরোজ আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে যদি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনে নিয়ে আসি তাহলে এরচেয়ে কম দামে কিভাবে বিক্রি করবো।

অধ্যাপক তিতুমীর বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা ছাপানো কমিয়ে পণ্যের দাম স্থিতিশীল করার পরামর্শ দিয়েছেন।

পণ্যের সরবরাহ খাতে প্রতিটি স্তরে চাঁদাবাজি বন্ধ ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ দূর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

1h ago