ব্যাংক-বিমা-শেয়ারবাজার সব খাতেই আস্থা সংকট

শেয়ারবাজার, ব্যাংক খাত, বিমা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ডিএসই,
স্টার ফাইল ইলাস্ট্রেশন

বাংলাদেশের ব্যাংক, বিমা ও শেয়ারবাজার সব ক্ষেত্রেই মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসনের অভাব ও অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই আর্থিক খাতে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।

ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে খেলাপি ঋণের মুখে পড়ছে। এছাড়া, দেশের বিমা খাত ঠিকভাবে মানুষের বিমা দাবি নিষ্পত্তি করছে না।

আর শেয়ারবাজারে কারসাজি করে মানুষের টাকা হাতানোর ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শেয়ারবাজারে মানুষের আস্থা এত কম যে, বাজার মূলধন অত্যন্ত কম। এছাড়া, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা কম এবং বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন কমছে।

এমন সময়ে দেশের আর্থিক অবস্থার এই দৈন্যদশা, যখন বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা সরকারকে সুপারিশ করছেন, আর্থিক খাতকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে। যেন, আর্থিক খাত দেশের উন্নয়ন যাত্রায় সঠিকভাবে অবদান রাখতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, করপোরেট গভর্নেন্স ও রেগুলেটরি গভর্নেন্সের অভাবে আর্থিক খাতে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।

তিনি জানান, করপোরেট গভর্নেন্সের অভাবে সম্পদের মান কমে যাচ্ছে। যেমন- ব্যাংকের পরিচালকদের নিজেদের মধ্যে ঋণ দেওয়া-নেওয়া দিন দিন বাড়ছে। এখানে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে না।

'মানুষ যখন এসব দেখতে পায়, তখন তারা কীভাবে বিশ্বাস করবে- তাদের অর্থ পেশাদার উপায়ে ও নৈতিকভাব ব্যবহার করা হচ্ছে? এছাড়া যখন মানুষ জানতে পারে- আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকেও প্রশ্রয় পাচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট আরও তীব্র হয়।'

জাহিদ হোসেন বলেন, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৬টি ব্যাংকের প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি ক্ষেত্র বিশেষে ৯ বছরের জন্য স্থগিত করেছে।

'এটি ভালো ঋণদাতাদের খারাপ অভ্যাসে জড়িত হতে উৎসাহিত করবে। এভাবে আর্থিক খাত যদি আস্থার সংকটে ভুগতে থাকে, তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার কারণ হতে পারে,' যোগ করেন তিনি।

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যখন বাড়বে, তখন মানুষের আয় বৃদ্ধি পাবে, তাদের সঞ্চয় বাড়বে। কিন্তু সঞ্চয়কারীরা যদি ব্যাংক, শেয়ারবাজার বা বিমা কোম্পানিতে অর্থ না রাখে- তাহলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো বিনিয়োগকে কীভাবে অর্থায়ন করবে।

'সুতরাং, বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে সরকারের উচিত আস্থা সংকটের উৎস অর্থাৎ সুশাসনের অভাব বন্ধে কাজ করা,' বলেন জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ সিদ্দিকীও একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সুশাসনের অভাবে দেশের সার্বিক আর্থিক খাত আস্থা সংকটে ভুগছে।

তিনি মনে করেন, ব্যাংকিং খাতকে কখনো কখনো অব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলাহীনতা, অনিয়ম, পুনঃতফসিল ও খেলাপি ঋণের কারণে ধুঁকতে হয়।

'কিছু মানুষ ব্যাংকের অর্থ স্রেফ নিয়ে চলে গেছে, তাই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।'

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় বোঝা এই উচ্চ খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। আর বর্তমানে খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ৮.৮ শতাংশ।

দেশের বিমা খাতও ভালো করছে না, কারণ বিমা দাবির বিপরীতে নিষ্পত্তির অনুপাত প্রত্যাশার চেয়েও অনেক কম।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে জীবন বিমা খাতে দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৭ শতাংশ, তার মানে ৩৩ শতাংশ দাবি অমীমাংসিত থেকে গেছে। নন-লাইফ বিমা খাতে দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত আরও কম, গত বছর যা ছিল ৩৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মাইন উদ্দিন বলেন, 'বিমা দাবি পূরণ না করায় বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে।'

এমনিতেই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ক্রেতার পরিমাণ কম। এর মধ্যে ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারবাজারে আগ্রহ আরও কমেছে। ফলে, মধ্যস্থতাকারী ও বিনিয়োগকারী উভয়ই শেয়ারবাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্বের কোনো শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস নেই। যখন ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মতো মধ্যস্থতাকারীরা শেয়ারবাজারে স্থিতিশীল আয়ের চেষ্টা করছে, তখন ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে গড় টার্নওভার ৬০০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার চেয়ে অনেক কম।

তালিকাভুক্ত ৩৯৭টি কোম্পানির মধ্যে ২০০টিরও বেশি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে এবং গত এক বছরে কোনো লেনদেন হয়নি।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, বেনিফিসিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্টের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কমে ১৭ লাখ ৪৪ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের প্রিমিয়ার এক্সচেঞ্জ অনুযায়ী, ডিএসই'র বাজার মূলধন-জিডিপি অনুপাত ১৭ শতাংশ, অথচ বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের ৬০ শতাংশের বেশি।

অধ্যাপক মাইন উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটও এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।

ফারুক আহমদ সিদ্দিকী বলেন, অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় আর্থিক খাতের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার যখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বা মামলা হচ্ছে, তখন অনেক অর্থ আত্মসাৎকারী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কারণে দেশের ব্যবসা খাত এখনো কঠিন পরিস্থিতিতে আছে। তবে বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান মনে করেন, দুর্নীতিই মূলত সব খাতের সমস্যা বাড়াচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে সুশাসন নিশ্চিতে অবহেলার কারণেই আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি সতর্ক করেন, আর্থিক খাতের সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করা না হলে, আগামী বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।

অধ্যাপক মাইন উদ্দিন বলেন, আর্থিক খাতের সব ক্ষেত্রে আস্থার সংকটে থাকলেও ব্যাংকিং খাত তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছে।

তিনি জানান, ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যা উচ্চ খেলাপি ঋণ, তবে এখনো ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। এই খাতটি উদ্যোক্তাদের প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থ সরবরাহ করছে।

শেয়ারবাজারে আস্থার অভাবকে একটি পুরানো সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'শেয়ারবাজারে অর্থ নিরাপদে থাকবে এই বিশ্বাস মানুষের নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Inflation 7% by next June: BB governor

Bangladesh Bank Governor Ahsan H Mansur yesterday said the interim government has set a target to reduce inflation to 7 percent by the end of next June and further below 5 percent in the next fiscal year..“We have reviewed many countries, including the US, the UK, European Union or Thailan

3h ago