উচ্চ খেলাপি ঋণে ধুঁকছে ১৬ আর্থিক প্রতিষ্ঠান
গত মার্চের শেষে দেখা যায়, দেশের প্রায় অর্ধেক ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ঋণের প্রায় এক তৃতীয়াংশ খেলাপি হয়ে গেছে। মূলত ৮ থেকে ১০ টি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অনিয়মের কারণে এ খাতটি এখন কঠিন সময় পার করছে।
তারল্যচাপের মধ্যে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এছাড়া অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন পরিস্থিতি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে দেশে ৩৫টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টির খেলাপি ঋণের অনুপাত ৩০ শতাংশের বেশি। এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো— গত মার্চের শেষে ১৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬টির ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুশাসনের অভাব আছে। তাই তাদের খেলাপি ঋণের অনুপাত বাড়ছে।'
তিনি মনে করেন, পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্ট টিমের অধিকাংশ সদস্যেরই ঋণের বিষয়ে সঠিক জ্ঞান নেই।
ঋণ মূল্যায়ন ও নিরীক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার অভাব আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যথাযথ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অনুপাত কমিয়ে রাখা যাবে না।
'কিছু প্রতিষ্ঠানের মূলধন তাদের খেলাপির তুলনায় কম, যা ভীষণ উদ্বেগের।'
তার সুপারিশ, যেসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভালো নয় সেগুলোকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একীভূত করে দেওয়া উচিত। এতে কম পরিচালন ব্যয়ে সেগুলো যথাযথভাবে চালানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হওয়ায় মানুষের আস্থাও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা এবং শ্রেণিকৃত ঋণ ১৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা।
উচ্চ খেলাপি অনুপাতের কারণে নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ২৫ শতাংশ ঋণ শ্রেণিবদ্ধ হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় খেলাপি ঋণের অনুপাত অনকে বেড়ে গিয়েছিল।'
'প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল তছরুপ করা হয়েছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এখন পুনর্গঠিত বোর্ড দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কেউই তহবিল সরবরাহ করতে চাচ্ছেন না।'
তার মতে, 'এর ফলে, আমরা বড় আমানতকারীদের ও নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ঋণদাতাদের—বিশেষ করে ব্যাংকগুলোকে বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি। ব্যাংকগুলো বোর্ডে থাকলে মানুষের আস্থা ফিরে আসতে পারে।'
'আস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে চলতে পারবে না আর চলতে না পারলে মানুষের টাকাও ফেরত দিতে পারবে না,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও তা শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
ব্যাংকিং খাতে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত খেলাপি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার বকেয়া ঋণের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখনো ভালোভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
৭ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি অনুপাত ৫ শতাংশের নিচে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড, ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসি, অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি লিমিটেড, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কায়সার হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত কঠিন সময় পার করলেও কিছু প্রতিষ্ঠান খেলাপি অনুপাত কম রাখতে পারায় তারা ভালো করছে।'
বিডি ফাইন্যান্সের খেলাপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
'এটি সত্য যে কিছু ঋণগ্রহীতা সত্যিই সমস্যায় আছেন। এটি ব্যবসার অংশ। কিন্তু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বোর্ড ও ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্যদের যোগসাজশে কাজ করায় খেলাপি অনুপাত বেড়ে গেছে।
তার মতে, 'প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুশাসন মেনে না চললে বেশিরভাগ ঋণ খেলাপি হয়ে যায়।'
কায়সার হামিদ আরও বলেন, 'সুদ আয় ও শেয়ারবাজার থেকে আয় কমে যাওয়ায় নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফাও কমেছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ঋণ ও ঋণের সুদের হারের মধ্যে ব্যবধান জুনে শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এর গড় ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।
কায়সার হামিদ মনে করেন, মুদ্রাবাজারে তারল্যের চাপ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে আরও জানা যায়, গত জুনে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এটি ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের আউটস্ট্যান্ডিং লোন সর্বোচ্চ। এর পরিমাণ ১০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ৭ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ৬ হাজার ৯১ কোটি টাকা ও ডিবিএইচ ফাইন্যান্স লিমিটেডের ৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা আউটস্ট্যান্ডিং লোন রয়েছে।
Comments