বিদেশি ব্যাংক কেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়

১৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি

অনিয়ম, অস্থিতিশীলতা ও ভালো কোম্পানির অভাবে বাংলাদেশে পরিচালিত ৯টি বিদেশি ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় না। ফলে, শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম।

এসব ব্যাংক বাংলাদেশের শেয়ারবাজার নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নয় এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর তাদের আস্থা নেই।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০২২ সালে পুঁজিবাজারে এসব ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা পুরো ব্যাংকিং খাতের মাত্র শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ।

স্থানীয় ৪৩টি ব্যাংক শেয়ারবাজারে ১৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, অর্থাৎ তাদের গড় বিনিয়োগ প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ফান্ড ম্যানেজার আসিফ খান বলেন, 'বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের মূল ব্যবসা থেকে বেশি হারে মুনাফা অর্জন করছে। তাই তারা সেখানেই মনোযোগ ধরে রেখেছে।'

'মূল ব্যবসা থেকে লাভ হওয়ায় বহুজাতিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে বাড়তি ঝুঁকি নিতে চায় না,' বলেন তিনি।

তাদের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মুনাফা ১০২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।

এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান আসিফ খান বলেন, স্থানীয় ব্যাংকগুলোও তাদের মূল ব্যবসা নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগী, কিন্তু তারা বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ১ দশমিক ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ, যা বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

ব্যাংক আল-ফালাহ, এইচবিএল বাংলাদেশ, উরি ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এই ৪টি ব্যাংকের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে কোনো বিনিয়োগ নেই।

কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া যথাক্রমে ৯৪ লাখ টাকা এবং ৩১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

সিটি ব্যাংক এনএ ও এইচএসবিসি বাংলাদেশ প্রত্যেকের বিনিয়োগ ৬০ লাখ টাকা।

এইচএসবিসি কেন বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বড় বিনিয়োগ করছে না জানতে চাওয়া হলে ইমেইলে তারা জানিয়েছে, '২৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে এইচএসবিসি বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে আন্তর্জাতিক সংযোগ ও বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ইন্টিগ্রেশনকে কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। এইচএসবিসির বহুমুখী পদ্ধতিতে পাইকারিও খুচরা বাজার, সিকিউরিটিজ কাস্টডি এবং ক্লিয়ারিং পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত আছে। যা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক দক্ষতাকে কাজে লাগায়।'

এইচবিএল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সেলিম বরকত বলেন, 'সাধারণত অস্থিতিশীলতা ও তারল্যজনিত কারণে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়।'

তিনি আরও বলেন, এটি উন্নত শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রেও সত্য, তবে সেখানে ইক্যুইটি পোর্টফোলিওতে মালিকানাধীন বিনিয়োগ মূলত খুচরা বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ড, পেনশন ফান্ড ও অ্যাসেট ম্যানেজারদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আসে।

'এইচবিএলের বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেই,' বলেন তিনি।

সেলিম বরকত মন্তব্য করেন, 'সাধারণত ব্যাংকগুলোর এ দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার মতো দক্ষতা নেই। তাই এসব ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা শেয়ারবাজারে ফেলে রাখতে চায় না।'

সিটি ব্যাংক এনএ এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আর্থিক বাজার বিশ্লেষক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংবের বেঁধে দেওয়া তারল্য অনুপাত ধরে রাখতে বিদেশি ব্যাংকগুলো সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে পছন্দ করে।

তিনি বলেন, 'শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। তাই তারা সেখানে বিনিয়োগ করতে চায় না এবং আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে ফেলার বিষয়টি তারা এড়িয়ে চলে।'

বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, 'বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী প্রত্যাশা করেন যে, ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদের জন্য বিনিয়োগ করবে, কিন্তু তারা নিজেরা প্রতিদিন শেয়ারবাজারে লেনদেন করে, যা প্রত্যাশিত নয়।'

বিশ্বব্যাপী বিমা বাজার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের খাতগুলোতে বিনিয়োগ করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, তবে এরা এখনো বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তারা ব্যাংকে তাদের অর্থ ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে রাখে বা সম্পদ কেনে, তাই শেয়ারবাজারে তাদের ভূমিকা কম থাকে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো পারফর্মিং কোম্পানির অভাব ও কাঠামোগত দুর্বলতা আছে।

'তাই বিদেশি ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে,' বলেন তিনি।তিনি জানান, বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু সেগুলোর খুব কমই সমাধান হয়েছে। এসব দুর্বলতার মধ্যে একটি হলো ম্যানিপুলেটরদের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয় না, আর বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ব্যাপকভাবে ম্যানিপুলেশন চলছে।

তিনি আরও বলেন, 'তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন মানসম্মত নয়। তাই বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী সেগুলো বিশ্বাস করে না।'

তিনি বলেন, 'এখানে বাজার স্থিতিশীল রাখার মতো ব্যবস্থা নেই এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতো আচরণ করেন।'

লেনদেনের ক্ষেত্রে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্যও বহুজাতিক ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকতে প্ররোচিত করে। সুতরাং, যখন কোনো বিনিয়োগকারী দেখে, 'জেড' ক্যাটাগরির বা দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো দর বৃদ্ধির তালিকা বা লেনদের তালিকার শীর্ষে আছে- তখন তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'যতক্ষণ না সরকার এসব কাঠামোগত সমস্যার সমাধান করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিদেশি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না।'

একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার মনে করেন, এসব ব্যাংকের শেয়ারবাজারে আসা উচিত নয়, কারণ তারা স্বল্পমেয়াদী আমানত নিয়ে কাজ করে। আর শেয়ারবাজার হলো দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের মাধ্যম।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো যদি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে তাদের যথাযথ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাই ফান্ড ম্যানেজারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে তাদের জন্য ভালো হবে।

তিনি মিউচুয়াল ফান্ড, পেনশন ফান্ড, বিমা কোম্পানি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

Comments

The Daily Star  | English
Government notification banning Awami League

Govt bans activities of AL until ICT trial completion

A gazette notification was issued in this regard by Public Security Division of the home ministry

2h ago