৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৯ হাজার ৪৮ কোটি টাকা

২০২২ সালে বাংলাদেশের ৮টি ব্যাংক ১৯ হাজার ৪৮ কোটি টাকার সমষ্টিগত প্রভিশন ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে ব্যাংকের আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

ব্যাংকগুলো হলো— ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। কৃষি ব্যাংক ছাড়া তালিকার বাকি ৭ ব্যাংক ২০২১ সালেও প্রভিশন ঘাটতিতে ভুগেছে।

প্রভিশন ঘাটতি তখনই ঘটে যখন হাতে থাকা নগদ অর্থের চেয়ে আর্থিক দায়বদ্ধতার পরিমাণ বেশি থাকে। এ বিষয়টি সাময়িক, কিছু অন্যান্য পরিস্থিতির সমন্বয়ে তৈরি অথবা ধারাবাহিক হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানটির দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের প্রতি ইঙ্গিত করে।

ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন হিসেবে সরিয়ে রাখে।

মন্দ ও ক্ষতিকর শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ব্যাংককে ১০০ শতাংশ অর্থ প্রভিশন হিসেবে আলাদা করে রাখতে হয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির অর্থ হলো তারা আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা না করেই মুনাফা ও লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করছে।'

তিনি বলেন, 'ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির জন্য দায়ী মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণ।'

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা মনসুর আরও বলেন, 'অতীতে ৮ ব্যাংকের অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারির শিকার হয়েছে। ফলে তাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।'

প্রভিশন ঘাটতিতে ভোগা ব্যাংকের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি কেলেঙ্কারির ঘটনার সাক্ষী হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০৩ শতাংশ বেশি। বেসরকারি ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত ডিসেম্বরে ১২ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা হয়েছে।

এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ বিতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই উদ্যোগ ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে পারেনি।

এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মেহমুদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২০২২ সালে ৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।

বলিষ্ঠ করপোরেট সুশাসনের জন্য পরিচিত এই রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ২০১০ ও ২০১১ সালে বড় আকারের আর্থিক কেলেঙ্কারির মুখে পড়ে। ব্যাংকটির গত বছরের বকেয়া ঋণের ৫৭ দশমিক ৫৫ শতাংশই খেলাপি।

বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুর রহমান বলেন, 'বর্তমান ব্যবস্থাপনা দল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।'

'আমাদের পরিচালন লোকসান কমছে। আমরা সবসময় আমানতকারীদের সময়মতো টাকা ফেরত দিই', যোগ করেন তিনি।

ডিসেম্বরে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৩৪৪ কোটি টাকা। এই ব্যাংকটিতেও ঘটেছে অসংখ্য অনিয়মের ঘটনা, যে কারণে এটি বছরের পর বছর প্রভিশন ঘাটতিতে ভুগছে।

এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক গত বছর ১৭১ কোটি টাকা ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছিল।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকটি কোনো অনিয়মের সম্মুখীন হয়নি।

তিনি বলেন, 'প্রভিশনিং ছাড়া ব্যাংকের সব সূচকই ভালো অবস্থায় রয়েছে। আমরা ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছি এবং আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।'

সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ গত বছর বাড়লেও প্রভিশন ঘাটতি ২০২১ সালের ১৪ হাজার ৭ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়।

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রভিশনিং ঘাটতির পরিমাণ নিয়ে অর্থনীতিবিদ মনসুর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

'অনেক ব্যাংক হয়তো তাদের প্রভিশন সঠিকভাবে গণনা করে না, তাই এর ফলে সামগ্রিক ঘাটতি হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে', যোগ করেন মনসুর। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিষয়টি নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেন।

তিনি জানান, প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকের দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং এ ধরনের ব্যাংকগুলো মন্দা পরিস্থিতির ধকল সামলে উঠতে অক্ষম।

'সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি জোরদার করা, যাতে তারা আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের প্রভিশন অবকাঠামো দৃঢ় করে', যোগ করেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'ঋণঝুঁকি কমাতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে হবে।'

'যেসব ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে, তারাও মুনাফা দেখায় এবং লভ্যাংশ দেয়। এটা যৌক্তিক নয়। এটি আমানতকারীদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে', যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Battery-run rickshaws allowed back on Dhaka roads for one month

SC chamber judge issues status quo on HC order

3h ago