ধুঁকতে থাকা ব্যাংকিং খাতে নতুন অস্থিরতা, বাড়ছে উদ্বেগ

বাংলাদেশ ব্যাংকে বিক্ষোভ, ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, খেলাপি ঋণ, শেখ হাসিনা,
ইসলামী ব্যাংকের একদল কর্মচারী মতিঝিলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করছেন। ছবি: পলাশ খান

খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাত। পাশাপাশি তারল্য সংকট, সুশাসনের অভাবসহ একাধিক সমস্যায় ভুগছে অনেকগুলো ব্যাংক। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, যা এই খাতের জন্য মোটেও শুভ লক্ষণ নয়।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

তবে এই বিক্ষোভ কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। শাখার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংক ও আমানতের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে ছড়িয়ে পড়েছে। গতকালও বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।

বেসরকারি তিন ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকেও শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বিক্ষোভ হয়েছে।

তবে গতকাল ইসলামী ব্যাংকের সামনে ব্যাংকটির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ সহিংসতায় রূপ নেয় এবং এই সংঘর্ষে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ব্যাংকের পরিচালকরা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, ইতোমধ্যে সেসব ব্যাংকের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক খাত নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়ছে। এমনিতেই এই খাত উচ্চ খেলাপি ঋণে ধুঁকছে।

এদিকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।

ব্যাংকাররা বলছেন, উচ্চ খেলাপি ঋণের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাংক বোর্ডের কার্যক্রমে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, 'এভাবে বিক্ষোভ করা ব্যাংকিং খাতের সমস্যার কোনো সমাধান নয়। বরং এতে সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।'

তার ভাষ্য, 'একেক ব্যাংকে একেক রকমের সমস্যা। তাই সব ব্যাংকে একই ওষুধ ও সমান ডোজ প্রয়োগ করা উচিত নয়।'

'কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করেছে। এখন একটি কমিশন গঠন করে তাদের সমস্যা বিশ্লেষণ করে প্রতিকারের পরামর্শ দেওয়া উচিত,' বলেন তিনি।

তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, 'ব্যাংকিং খাতের খুব সাধারণ একটি সমস্যা হলো সুশাসনের অভাব। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত নজরদারি বাড়ানো, তাহলে এই সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব।'

একটি ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিক্ষোভকারীদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা যেন, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের বোর্ড ভেঙে দিতে বাধ্য হয়। তাহলে আগের সরকারের আমলে পরিচালক পদ থেকে বঞ্চিত অন্যান্য বড় শেয়ারহোল্ডাররা তাদের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।

তিনি পরামর্শ দেন, সামগ্রিকভাবে ব্যাংক ও এ খাতের সুবিধার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক বোর্ডগুলো ভেঙে দিতে পারে বা পরিচালকদের অপসারণ করতে পারে এবং রুগ্ন ব্যাংকগুলোতে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দিতে পারে।

'এতে ব্যাংকগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসবে,' বলেন এই কর্মকর্তা।

অর্থনীতি বিশ্লেষক, প্রবীণ ব্যাংকার ও পিডব্লিউসি বাংলাদেশের সাবেক ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ বলেন, 'রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব যখনই কোনো ব্যাংকের পর্ষদে প্রবেশ করেন, তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ও তদারকি দুর্বল হয়ে পড়ে।'

তার ভাষ্য, 'বোর্ডের সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।'

মামুন রশিদ বলেন, 'তাই প্রকৃত স্পন্সর, প্রমোটার এবং যাদের দক্ষতা আছে তাদের দিয়ে ব্যাংকগুলো পরিচালনা করতে হবে।'

তিনি পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কমিটিও গঠন করতে পারে। তাহলে কমিটি বিশ্লেষণ করতে পারবে ব্যাংকগুলোর স্পন্সরদের মধ্যে কারা সবচেয়ে উপযুক্ত।

'ব্যাংকগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়। এর পরিবর্তে আর্থিক খাত নিয়ে যথাযথ জ্ঞান ও পর্যাপ্ত দক্ষতা আছে এমন লোককে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে,' বলেন তিনি।

তিনি জানান, কমিশন একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেন ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে থাকে। এছাড়াও, একটি পরিবারের সদস্যরা কতদিন পরিচালক পদে থাকতে পারবেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে পারে।

একইসঙ্গে একটি পরিবারের কতজন সদস্য একটি ব্যাংকের পরিচালক পদে বসতে পারবেন তার রূপরেখা দিতে পারবে কমিশন।

সিএফএ সোসাইটির সভাপতি ও এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান আসিফ খান বলেন, 'শেষ মুহূর্তে কোনো কর্মকর্তা যেন অর্থ নিয়ে পালাতে না পারেন, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।'

'তাই এ ধরনের হুমকিতে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় এ ধরনের বিশৃঙ্খলা ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করবে,' মনে করেন তিনি।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, 'অতীতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বলপূর্বক দখলে নেওয়ায় বিক্ষোভ হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'এখন মূল মালিকরা তাদের কর্তৃত্ব জাহির করছেন।'

'সমস্যা মূলত ব্যাংক মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের মধ্যে, যারা পরিচালক পদ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সুতরাং এতে আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই,' বলেন আনিস এ খান।

Comments

The Daily Star  | English

What are the factors leading to labour migration from Bangladesh?

A father of one, Fahimuzzaman said that his income in Bangladesh did not allow him to build any savings

1h ago