সতর্কবাণী পেলাম, যেন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ না করি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৩ জুন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। ওই বক্তৃতায় উঠে আসে তার মা-বাবার স্মৃতি, শৈশব কৈশোরের দিনগুলোর বর্ণনা, শিক্ষা ও সাহিত্য জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। সবমিলিয়ে তার এই বক্তৃতা যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

এই শিক্ষাবিদের দেওয়া আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো ৭ পর্বে প্রকাশিত হচ্ছে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন ইমরান মাহফুজ, খালিদ সাইফুল্লাহ ও মোহাম্মদ আবু সাঈদ। আজ এর ষষ্ঠ পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে।

শিক্ষক সমিতির যে তিনজন সম্পাদক ছিলেন—ডক্টর কায়েস, ডক্টর রফিকুল ইসলাম এবং আমাদের এক বন্ধু—তিনজনকেই ধরে নিয়ে গেছে। আহসানুল হক নামে আমাদের এক সহকর্মীকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে আবার আগস্ট মাসে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি তখন হবিবুল্লাহ্‌ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার মনির ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন না যে আমাদেরকে কেন ডাকা হয়েছে ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে? তখন স্যার বললেন, 'হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।' আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি কি যাবেন? তো তিনি বললেন, 'হ্যাঁ আমি যাব।' আমি বললাম, ঠিক আছে, তাহলে আপনার সাথে আমিও যাব।

আমি একটু সকাল সকাল উঠে গিয়ে দেখলাম যে, কোনো মিলিটারি আছে কিনা। গিয়ে দেখলাম না, কোনো মিলিটারি নেই। মোহাম্মদ সেলিম; ভাইস চ্যান্সেলরের সেক্রেটারি, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? বলল, সিল মারা চিঠি এসেছে, আপনাদেরকে ডেলিভারি করবে।

আমরা একজন একজন করে যাচ্ছি। তখন দেখা গেল হবিবুল্লাহ্‌ সাহেবের চাকরি চলে গেল, এনামুল হক সাহেবের চাকরি চলে গেল, আমরা তিনজন সতর্কবাণী পেলাম যে, আমরা যেন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ না করি। মো. মনিরুজ্জামানের বিষয়ে তারা খুব ক্ষেপেছিলেন।

মনিরুজ্জামানের অপরাধ হচ্ছে তিনি তখন গান লিখছেন এবং সেই গানগুলো তখন গাওয়া হতো। এখানে মজার বিষয় হল যে, মনিরুজ্জামান কিন্তু গানগুলো পাকিস্তানের পক্ষে লিখেছিলেন। কিন্তু গানের মধ্যে বাংলাদেশের কথা আছে এবং তা শুনে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা বুঝেছিলেন যে, এটা তো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ, তাদেরকে ধরতে হবে। তখন মনিরুজ্জামানের শাস্তি হলো ছয় মাসের জেল। আমি তখন বেঁচে গেলাম।

দ্বিতীয়বার হামলা হলো—আপনারা জানেন—১৪ই ডিসেম্বর। রাও ফরমান আলীর যে ডায়েরি পাওয়া গেছে, সে ডায়েরিতে শিক্ষকদের নাম ছিল, সেখানে আমার নামও ছিল। যাদের নামের পাশে ঠিকানা লেখা ছিল, তাদেরকে ধরে নিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু, আমার নামের পাশে কোনো ঠিকানা ছিল না, কারণ আমি ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারের কোনো ঠিকানা দেইনি।

আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। যখন মিলিটারি ক্ষমতায় আসলো, তখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাছে ১৫ জন শিক্ষকের ঠিকানা চাওয়া হয়েছিল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার আত্মীয় ছিলেন। তিনি আমাকে জানালেন যে, তোমার নাম তো আমি দেখলাম, পাঁচ নম্বরে। কিছুদিন পরে তিনি জানালেন যে, আমরা অফিসার পাঠিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে ঠিকানা সংগ্রহ করার জন্য। তোমার ইউনিভার্সিটির ঠিকানা সংগ্রহ করেছে। সেই ঠিকানা হলো, আমি যখন প্রথম চাকরির জন্য দরখাস্ত করি তখনকার ঠিকানা। এ কারণে আমি ১৪ ডিসেম্বর বেঁচে গেলাম।

সে সময় আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন সৈয়দ আলী আশরাফ। তিনি তখন করাচি ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর। তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংকের এক বাঙালি কর্মকর্তার মাধ্যমে আমাকে খবর পাঠালেন যে, করাচির এক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট করা হবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে, সে যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার সাথে সাথে চলে আসে।

তখন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন যাচ্ছেন বিদেশে, সৈয়দ আলী আশরাফের বাসায় উঠেছেন। তারা বিভিন্ন শলা-পরামর্শ করেছেন, আমার ব্যাপারে তাদের পরামর্শ হচ্ছে যে, আমি ঢাকা ত্যাগ করবো এবং বেঁচে যাব। কারণ পাকিস্তান তো টিকবে। তো কিছুদিনের মধ্যেই আমি টেলিগ্রাম পেলাম, আমাকে জয়েন করতে বলা হলো। কিন্তু, আমি জবাব দিলাম যে, আমি তো যেতে পারবো না, আমার মা খুব অসুস্থ। আমি তখন সাজ্জাদ সাহেবকে বললাম, স্যার, আমি তো না করে দিয়েছি; তিনি শুনে খুব বিষণ্ন হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, তোমার তো সর্বনাশ হয়ে গেল, তুমি বাঁচবে কিভাবে? আমি বললাম—স্যার করাচিতে গেলে তো আমি আটকা পড়ে যাব, এখানে তো তাও আছি কোনোরকম। তিনি বুঝেছিলেন যে, আমি যে মায়ের কথা বলেছি তা আমার নিজের জন্মদানকারী মা নয়, তা দেশ।

১৪ ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবী হত্যা, তার ব্যাপারে সারাবিশ্বেই কম বেশি খবর ছড়িয়ে পড়েছে। আমার যিনি পিএইচডির সুপারভাইজার ছিলেন তিনি খুব সংবেদনশীল মানুষ। ১৬ ডিসেম্বরের পরে আমি চিঠি লিখলাম যে, স্যার, আমি বেঁচে আছি। তিনি পরে যে চিঠি লিখেছিলেন তা খুবই মর্মান্তিক। তিনি লিখেছেন যে, তোমার ব্যাপারে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম, আমরা খবরের কাগজে Chowdhury নাম দেখে ধরে নিয়েছিলাম যে, তোমাকে মেরে ফেলা হয়েছে; তোমার সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে আমি বহু নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি; তোমার পিএইচডি থিসিসটা যেন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশ করা হয় তার বন্দোবস্ত পর্যন্ত করেছি। তারপর হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তিনি বললেন যে, তুমি মারা গিয়েছো এই খবর তো আমরা ছেপে দিয়েছি, এখন আমাদের সংশোধনী দিতে হবে। তো, এইরকম আন্তর্জাতিক একটা সমবেদনা ছিল।

আমার স্ত্রীর কথা বলতে হবে এখন। তিনি তো খুব অল্প বয়সে মারা গেছেন, পঞ্চাশ বছর‌ও হয়নি। নাজমা এখানে এসে কিশোরদের জন্য নাট্য আন্দোলন করেছে, নাটক লিখেছে, গল্প লিখেছে, কবিতা লিখেছে, প্রবন্ধ লিখেছে, পিএইচডিও করলো, শেষ পর্যন্ত ক্যানসারে মারা গেল। তখনো ক্যানসারের ভালো কোনো চিকিৎসা ছিল না। নাজমার যেদিন রোগটি ধরা পড়লো, সেদিনই চিকিৎসকের কথায় পিজিতে ভর্তি হলো। কিন্তু, তিন সপ্তাহ তাকে চিকিৎসার জন্য ওয়েট করতে হলো।

কিন্তু, সে অনুভব করতে পারছিল যে, প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে টিউমারটা বাড়ছে। তারপর অপারেশন হলো, মস্ত বড় এক টিউমার বের করা হলো, ফিজিওথেরাপির কথা আসলো, তখনো কেমোথেরাপির কথা আসেনি। তার দুই ভাই ডাক্তার ছিল, আমেরিকাতে, সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো।

কিন্তু, ততদিনে ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। পরে সেখানে কেমোথেরাপি হলো, হুইল চেয়ার নিলো। কিন্তু, আমাদের অনেক আগেই কেমোথেরাপি নেওয়ার দরকার ছিল, যেটা আমরা পরে বুঝেছি। নাজমা তো এভাবেই চলে গেল। কিন্তু একটা পর্যায়ে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়ে গিয়েছিল। সে থিসিস লিখেছিল, বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি। তার সুপারভাইজার ছিলেন, আহমদ শরীফ। তিনি একটা লম্বা লিস্ট দিয়েছিলেন যে, এইসব ব‌ই তোমাকে পড়তে হবে। সেইসব ব‌ইপত্র পড়ে সে থিসিস করল এবং পরবর্তীতে তা পিএইচডি হিসেবে গৃহীত হলো। তার ভারতীয় সংস্করণ‌ও বের হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Aug 21 grenade attack cases: HC to deliver verdict any day

The High Court is set to deliver its verdict any day on the death references and appeals of the August 21 grenade attack cases

23m ago