পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৩ জুন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। ওই বক্তৃতায় উঠে আসে তার মা-বাবার স্মৃতি, শৈশব কৈশোরের দিনগুলোর বর্ণনা, শিক্ষা ও সাহিত্য জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। সবমিলিয়ে তার এই বক্তৃতা যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

এই শিক্ষাবিদের দেওয়া আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো ৭ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন ইমরান মাহফুজ, খালিদ সাইফুল্লাহ ও মোহাম্মদ আবু সাঈদ। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর দ্বিতীয় পর্ব।

১৯৪৭ সালে ঢাকা শহরে আমাদের থাকার কোনো জায়গা ছিলো না। আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছি। সেই আত্মীয়ের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, পানির সরবরাহ ছিল না। তারপরে আরেকটা বাড়িতে গেলাম ১ নং নাজিরা বাজারে,  সেখান থেকে বেগম বাজারে গেলাম। সেইখানে আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম। তারপর ১৯৫০ সালে আজিমপুর কলোনি হলে ৫০০ সরকারি কর্মচারী পরিবার সেখানে আশ্রয় পেল। সেখানে আমরা পানি পেলাম, বিদ্যুৎ পেলাম। তো এই ছিল আমাদের দেশভাগ পরবর্তী সময়ের পটভূমি।

দেশভাগের পরের যে ঘটনাটা আমার মনে আছে, সেটা আমি এখানে একটু বলব। সেটা হলো যে, আমরা কলকাতা থেকে চলে এলাম গোয়ালন্দ হয়ে, ভাগ্যকূলে মামাবাড়িতে নামলাম। সেখানে সব মানুষ চলে এসেছে কলকাতা থেকে। তখন আমরা দেখলাম, যারা সরকারি চাকরি করতেন, তারা অকশন দিয়ে এসেছেন। কিন্তু যারা বেসরকারি চাকরি করতেন,  ছোটখাট ব্যবসা করতেন, তারা বেকার হয়ে গেছেন। তো এই যে বেকারত্বের যে সমস্যাটা, তখন আমাদের মধ্যেও এইটা ছিল।

১৪ আগস্ট পাকিস্তান হবে, আমরা ওই ভাগ্যকূলে গেলাম এবং দেখলাম সেখানে গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে করে যেন পাকিস্তান আসছে। তো গোয়ালন্দ থেকে তারা এসে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, নারায়ে তাকবির দিল, কিন্তু কোনো আনন্দ দেখলাম না। আর গোটা এলাকাতে আমার মনে হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এটা হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা।

তারপরে যেটা হয়েছে সেটা আমার ছোট ছোট অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বলি। ১৯৫০ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গেছি। দেখি যে আমাদের বন্ধুরা, যারা ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত পড়েছে, পরীক্ষা দেবে, ভালো ছাত্র সেই সুবিমল, সুধাংশু, পরিমল তারা কেউ পরীক্ষা দিতে আসেনি। সেই ৫০ সালে রায়ট হয়েছে, তারা চলে গেছে। শিবরঞ্জন, খাস্তগীর তারা সবাই চলে গেছে। একজন শুধু এসেছে পরিমল, নবাবপুরে ওদের ফার্মেসি ছিল। পরীক্ষা দিয়ে সেও চলে যাবে। এই যে ৫০ সালে বুঝলাম যে, পাকিস্তান কী করেছে!

তারপরে দেখেছি, আমাদেরই এক কাজিন, তাকে আমরা খুব সম্মান করতাম। তার বাবা স্টিমার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। স্টিমার কোম্পানি তো বেসরকারি ছিলো। তার সেখানে চাকরি নাই, বেকার হয়ে গেছেন। ছেলেকে উনি পাঠিয়েছেন বরিশালে আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে ম্যাট্রিক কোনরকমে পাশ করেছেন, কলেজে ভর্তি হয়েছে আর পারেনি। আমি কলেজে ভর্তি হয়ে বই কিনতে গেছি বাংলাবাজারে, দেখি আমার ওই বড় ভাই ফেরিওয়ালা হিসেবে বসে আছেন রাস্তার ধারে, টেবিলের উপরে কতগুলো বই সাজিয়ে নিয়ে। তো এই যে তিনি এই এই জায়গায় চলে এসেছেন, ওখানে কলকাতায় গুছিয়ে বসেছিলেন,  কিন্তু এখানে এসে বইয়ের ফেরিওয়ালা হয়ে বসেছেন।

আমাদের সাথে জোয়াদ আলী ছিলেন, আমাদের বাসার পাশেই। তখন এইরকম পার্থক্য ছিলো না। দেয়াল বলতে তখন আমরা কিছু দেখিনি কিন্তু। পাকিস্তান আমলেও দেয়াল তুলতে দেখিনি। দেয়ালগুলো তৈরি হলো বাংলাদেশ আমলে। তো ওখানে দেয়াল ছিলো না, পাশের বাড়ি। জোয়াদ আলী নৌকা চালাতেন। আঁড়িয়াল বিলে ছিল তুফানি নৌকা। তো আমি তখন হরগঙ্গা কলেজে চাকরি নিয়েছি। একদিন দেখি সেই জোয়াদ আলী আমার কাছে এসেছে। মেঝের মধ্যে বসে পড়েছে। আমি বলি, চাচা আপনি এখানে? তো দুটো কথা বললেন। একটা হলো, তুমি তো প্রফেসর হয়েছো, তাই তোমার সাথে দেখা করতে এলাম। আরেকটা কথা বললেন, 'আমি ডাকাতির মামলায় জামিন পেয়েছি, সেই মামলায় আবার হাজিরা দিতে এসেছি।'  তো  আমি প্রফেসর হয়েছি, এইটা হচ্ছে আমাদের কিছু কিছু লোকের যে সমৃদ্ধি এলো, তার নিদর্শন। আর জোয়াদ আলী চাচা যে ডাকাতির মামলায় আসামি হয়ে গেছেন, এইগুলো পাকিস্তান আমলে আমাদের সামনে ঘটে গেল।

আর দেখলাম, আজিমপুর কলোনিতে আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে এসেছেন রিজভী সাহেব। সম্ভ্রান্ত একটি পরিবার। বিহার থেকে এসেছেন অকশন দিয়ে। তার তিনটি মেয়ে। একটি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ফরিদপুরে কোনোমতে। আরেকটি মেয়ে ঘরেই থাকে, তাকে বিয়ে দিতে পারে না। ছোট মেয়েটা বখশিবাজারে যখন উর্দু মিডিয়াম স্কুল হলো, তখন স্কুলে ভর্তি হলো। রিজভী সাহেব হোমিওপ্যাথ ছিলেন। তিনি ওই দরজার উপরে লিখেছেন, 'এএইচ রিজভী, হোমিওপ্যাথ।' আমার বাবা তার রোগী ছিলেন। এই রিজভী সাহেব পরে ক্যানসারে মারা গেলেন। এই যে পরিবার, বিহার থেকে এসেছেন। বিহার তো খুব মুসলিম লীগের পক্ষে ছিলো। তিনি যে এখানে এসে এইভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে গেলেন, সেইটা আমার কাছে পাকিস্তানের চোখ বলে মনে হয়েছে।

আমাদের যেই আত্মীয় কলকাতাতে নামকরা ডেন্টিস্ট ছিলেন, তিনি এখানে কোথাও দোকান খুলবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। যিনি ওইখানে ক্র্যাফটস.... দোকান খুলেছিলেন দর্জির, তিনি এখানে দর্জির কোনো জায়গা পাচ্ছেন না, এইটা হচ্ছে পাকিস্তান আমলের চোখ।

তারপরে বাংলাদেশ হলো। বাংলাদেশ যখন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা তো গ্রামে যাতায়াত করছি। আমাদের মনে হচ্ছিল যেন গ্রাম জেগে উঠবে, এখানে আমরা থাকব। কিন্তু সেখানে আমরা থাকতে পারলাম না। এই যে বাংলাদেশ হলো, তার অভিজ্ঞতা ওই প্রথমদিকেই আমি পেয়েছি। আমরা শেষ পর্যন্ত নৌকা করে যেতে পারলাম না। ওই ১১ ডিসেম্বর রওনা হয়েছিলাম। আমরা সদরঘাটে আটকে গেলাম। কেননা, নৌকা ছোট ছিল, মনে হলো ডুবে যাবে। অনেক আত্মীয়-স্বজন চলে এসেছে, আমাদের বাড়িতে তারা যেয়ে উঠবে। আমরা থেকে গেলাম পরেরদিন যাব বলে। পরেরদিন আর যাওয়া হয়নি। কারফিউতে আটকা পড়ে গেলাম। সেইদিন রাজাকারদের আওয়াজ দেখে মনে হলো ভয়ের মধ্যে আছে। তারপর ১৬ ডিসেম্বর যখন আত্মসমর্পন হলো, ওই লোকগুলো যাদেরকে আমরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ করতে দেখেছি রাস্তায়, তারা দেখি জয়বাংলা বলে আওয়াজ দিচ্ছে।

শেখ মুজিবের ছবি কোথা থেকে নিয়ে এসেছে সেগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপরে ১৭ তারিখে আমি যে বাড়িতে ছিলাম, সেখানকার এক বন্ধুর সাথে বেরিয়েছি। ১৭ তারিখে দেখলাম লুন্ঠনের উৎসব। দেখলাম গোটা গভমেন্ট হাউজ লুট হয়ে যাচ্ছে। যেখানে রাও ফরমান আলী, টিক্কা খান ছিল, সেই বাড়িগুলো লুট হয়ে যাচ্ছে, যেন বিয়েবাড়ি।

এক লোক দেখলাম সেলাই মেশিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেন উপহার নিয়ে যাচ্ছে। আর ওই জিন্নাহ এভিনিউতে সব লুট হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখলাম যে কাদের সিদ্দিকী বক্তৃতা করছে পল্টনে। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বক্তৃতা করলেন। তারপরে বললেন যে ৩ জন রাজাকার এখানে ধরা পড়েছে, বিহারী। তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। এবং সত্যি সত্যি কার্যকর করার আওয়াজ আমরা শুনতে পেলাম। তারপরে আমরা ফিরে আসছি হাটখোলার মোড়ে, আহমদ কামাল, আমাদের ইতিহাস বিভাগের অধাপক, সে দেখি রিকশা থেকে লাফিয়ে পড়ে 'স্যার আপনি বেঁচে আছেন' বলে আমার দিকে আসছে। একটু ঠাট্টার মতো করে।

আমি বললাম, কেন কী হয়েছে? বলল, আমরা তো মনে করছি আপনিও নাই। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের সহকর্মীদেরকে ধরে নিয়ে গেছে, এবং আমারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। কাজেই ওরা ধরে নিয়েছে যে আমিও ওর মধ্যে আছি। তো আমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছে যে, আমি বেঁচে আছি। তারপর যখন জানতে পারছি যে অনেক আপনজনেরা মারা গেছে, তখন এসব দেখে ধাক্কা খেলাম।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago