পাকিস্তান অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে

তখন আমাদের গ্রামে এত শ্রেণিবিভাজন ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা তো ছিলই না।

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৯ জুন শিশু  একাডেমি মিলনায়তনে (ফিরে দেখা) একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় উঠে আসে তার মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ ও স্মৃতি, শৈশবের দিনগুলো। সবমিলিয়ে তার বক্তৃতাটি যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো পাঁচ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন মোস্তফা মুশফিক ও ইমরান মাহফুজ। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর দ্বিতীয় পর্ব।

আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, অবসর নিয়ে এসেছেন। সৌভাগ্যক্রমে তাদের হেড অফিস ছিল কলকাতায়। সেজন্য হেড অফিস থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন। কিন্তু আমরা কোথায় গিয়ে উঠবো, কোথায় থাকার জায়গা হবে, সেটা আমরা জানতাম না। এই ঢাকা শহরে আমরা প্রথম যখন নামি, আমার মেজো ভাই (প্রয়াত) বলেছিলেন, ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নেমে তার কান্না পেয়েছে এটা ভেবে যে কোথা থেকে আমরা কোথায় এলাম—যেখানে টিমটিম বাতি, যেখানে আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি, ঘোড়ার গাড়ি, দুর্গন্ধ, ধুলো। আমরা কোথায় গিয়ে উঠবো, ঠিক নেই। উঠেছিলাম আত্মীয়ের বাড়িতে—নাজিরা বাজার। কিন্তু সেখানে ভাড়া নেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। সেখানে বিদ্যুৎ নেই, স্কুল নেই।

সেখান থেকে আমরা গেলাম আরেক আত্মীয়র বাড়িতে। সেই আত্মীয়র বাড়ি থেকে বেগম বাজার আমার স্কুলে যেতে থাকলাম। আমাদের নুরজাহান আপা—তিনি কলকাতায় খুব দাপটের সঙ্গে ছিলেন—রায়টের সময় নাটকের সঙ্গে ছিলেন, গানও করতেন এবং ওখান থেকে পরীক্ষায় পাস করেছেন। ঢাকায় এসে মহিলা মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তিনি অল ইন্ডিয়া রেলওয়েতে চাকরি পেয়েছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'তুমি কোন স্টেশনে যেতে চাও'। তিনি বলেছিলেন, 'যেকোনো স্টেশনে, শুধুমাত্র ঢাকা ছাড়া'। শেষ পর্যন্ত তাকে ঢাকাতেই আসতে হলো। ১৯৫৪ সালে ধাক্কা খেয়ে তাকে যেতে হলো মুর্শিদাবাদে, সেখানে তিনি ছিলেন। পরে আবার তাকে এখানে ফিরতে হলো। এটাই ছিল পার্টিশন।

১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস কীভাবে পালন করা হবে বলাবলি করছিলাম। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমার এলো। পাকিস্তানের স্টিমার। তার সামনে কাগজে আঠা দিয়ে পাকিস্তানের পতাকা লাগানো। সেখান থেকে চিৎকার হচ্ছে—নারায়ের তাকবীর, আল্লাহু আকবার। আমরাও স্লোগান দিচ্ছি। কিন্তু আমার মনে হলো, এখন আরও বেশি করে মনে হয় চতুর্দিকে একটা বিষণ্ণতা ছিল, আর কোথাও কোথাও চাপা কান্না ছিল। বিশেষ করে যারা সংখ্যালঘু, তাদের মধ্যে কান্না ছিল প্রচুর এবং সেই স্বাধীনতা উপভোগ করেনি।

আবার আমার মনে পড়ে—কত উত্তেজনা দেখেছি, সেদিন কত উল্লাস দেখেছি। তারপরে যেটা ঘটলো, সেটা আমার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। যেমন ধরুন, আমাদের যারা আত্মীয়-স্বজন বেসরকারি চাকরি করতেন, তারা বেকার হয়ে গেলেন। যিনি পড়াশোনা করছিলেন, তিনি কী করবেন? আমারই দুই সহপাঠী, আমারই সমবয়সী, স্কুলে পড়তে তাদের একজন চলে গেল হাওর এলাকা তাহিরপুর। তার বাবা চাকরি পুলিশে দারোগা ছিলেন, ওসি হয়ে চলে গেলেন। তারপরে তার জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে গেল। আরেকজনের বাবা চাকরি করতেন স্টিমার কোম্পানিতে। তার বাবা বেকার হয়ে গেলেন। ছেলেটি বরিশালে আত্মীয়র বাড়িতে পড়তে লাগলো। এভাবে সবকিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। এদিকে আমরা স্কুলে গেলাম, পড়লাম, ইত্যাদি ইত্যাদি করলাম।

এখন কোনো একটি ছবিকে যদি ওই সময়ে প্রতীক হতে হয়, তাহলে দুটি ঘটনাকে দেওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক যেমন ছিল ওই ফাঁসিতে ঝোলা মানুষটি। তেমনি পাকিস্তানের এই সময়ের দুটি ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। একটা হচ্ছে, আমাদেরই প্রতিবেশী হায়াত আলী, জমাত আলী—একই পরিবারের। তখন আমাদের গ্রামে এত শ্রেণিবিভাজন ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা তো ছিলই না। আমার মায়ের খুবই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন নিম্ন পরিবারের। তার নাম গোয়ালিনীর মা। এটা শুনেই বুঝতে পারছেন তার সংসারের অবস্থা কী, তার শ্রেণিগত অবস্থানটা কী। কিন্তু দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। আমাদের খালের পাড়ে মসজিদ, দূরে মন্দির। প্রতিদিন আজান হয়, মন্দিরে ঘণ্টা বাজে। কোনো বিরোধ আমরা দেখিনি। জানতামও না বিরোধ।

যাইহোক, পাকিস্তান হলো এবং পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে আমি বড় হলাম। যেটা শুনেছেন আমার জীবনবৃত্তান্তে। আমি এমএ পরীক্ষা দিয়ে মুন্সীগঞ্জে লেকচারার হয়েছি। একদিন বিকেলে দেখি, দুই ভাই হায়াত আলী ও জমাত আলীর একজন হায়াত আলীকে আমার বাবা চাকরি দিয়েছিলেন। পিয়নের চাকরি, রাজশাহীতে। কাজেই হায়াত আলীর অবস্থা খারাপ নয়। জমাত আলী নৌকার মাঝি ছিলেন। তাকে আমরা তুফানি বলতাম এই অর্থে যে, তুফানের বিরুদ্ধে চলতে পারেন এবং তুফানের বেগে চলতে পারেন।

তার নিজের নৌকা ছিল না, অন্যের নৌকা বাইতেন। একদিন বিকেলে সেই তুফানিকে দেখি, আমি যেখানে শিক্ষকতা করি—হরগঙ্গা কলেজ—সেখান এসেছেন। তাকে চাচা বলে ডাকতাম। দেখি তার মলিন চেহারা। জিজ্ঞেস করলাম, 'চাচা আপনি এখানে?' তিনি বললেন, 'আমি শুনলাম, তুমি এখানে পড়াও। সেজন্য দেখা করতে আসলাম।'

'কী জন্য এসেছিলেন?' বললেন, 'আমাকে ডাকাতির মামলায় আসামি করা হয়েছে।' ডাকাতির মামলায় আসামি হয়ে এসেছেন তুফানি। আমাকে এমন ধাক্কা দিলো! আমার কাছে মনে হলো, হতে পারে তিনি ডাকাতিতে যুক্ত ছিলেন, অসম্ভব নয়। কেননা তার জমিজমা কিছুই নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র তাকে, এমন আরও অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ওইদিন সেই তুফানি চাচার যে ছবি, সেটা আমার কাছে পাকিস্তানের প্রতীক মনে হয়েছে।

১৯৫০ সালে এপারে ওপারে ভয়ংকর রায়ট হলো। সেখানে তারা থাকতেই পারল না। জায়গা জমি বিক্রি করে, দোকানটা বিক্রি করে দিয়ে, মেহেরুন্নেসার বাবা ঢাকা চলে এলো। ঢাকায় তাদের থাকার কোন জায়গা নেই, এই ধোলাইখালের পারে কোথাও একটা জায়গা নিয়ে মেহেরুন্নেসার বাবা ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু ব্যবসা করতে তো পুঁজি লাগে কিন্তু সেই পুঁজি সেই টাকা তারা কোথায় পাবে।

মেহেরুন্নেছা বাবাকে সাহায্য করার জন্যই আর পড়াশোনা করতে পারেননি। তিনি কবিতা লিখছিলেন। বাংলা একাডেমিতে লেখা কপি করতেন, কোথাও প্রুফ দেখতেন কোম্পানিতে একটা চাকরি নিয়েছিলেন। এর মধ্যে তার বাবার ক্যান্সারে মারা গেল। মেহেরুন্নেছা মিরপুরের একটা বিহারী অধ্যুষিত এলাকাতে থাকতো। মেহেরুন্নেসা খুবই তেজী মেয়ে ছিলেন, জয় বাংলা বলে স্লোগান দিতেন মিছিল করতেন বিহারীরা তা জানতো।

বাংলা একাডেমির নিচে মাঠে কবিদের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল, বিপ্লবী কবিদের কবিতা পাঠ হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা ২৩ মার্চ সেখানে কবিতা পড়ে এবং সেই কবিতা আমি শুনেছি ২৫ মার্চ এবং পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু ২৫ মার্চে মেহেরুন্নেছার বাড়িতে আক্রমণ করল, বাড়িতে তার মা তার ভাই এবং উপার্জনক্ষম মেহেরুন্নেছা। তার মা কোরান শরীফ বুকে নিয়ে  মেয়ের সামনে দাঁড়ালো। কিন্তু পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী উন্মত্ত বাহিনীরা সেখানেই তাদের তিনজনকে হত্যা করল এবং ভাইয়ের মাথাটা কেটে নিয়ে চলে গেল। মেহেরুন্নেসার সাথে সাথে যা করল সেটা আরো ভয়ঙ্কর, তাকে একা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দিল। এই হচ্ছে পাকিস্তানের আরেক প্রতীক। এক প্রতীক ওইখানে আরেক প্রতীক এইখানে।

Comments