সমষ্টিগত স্বপ্নটি এখন আর নেই

sirajul_islam_chowdhury
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

একাত্তর সালের কথাটি বার বার নানা ভাবে আসে। তা ছিল কঠিন দুঃসময়। আমরা প্রত্যেকেই ভীষণ বিপদে ছিলাম। প্রত্যেকটি দিন, প্রতিটি রাত, এমনকি মুহূর্তও ছিল আতঙ্কের। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েই ভাবতাম, বড়জোর আপনজনদের বিষয়ে, এর মধ্যেও আমরা ব্যস্ত ছিলাম। খবরের আদান-প্রদান করি, কোথায় কী ঘটছে জানতে চাই, রেডিও শুনি, মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করি, আর যারা যুদ্ধে ছিলেন তাদের তো মরণপণ অবস্থা। আমাদের সবার জন্য কাজ ছিল। বিপদ আমাদের তাড়া করছিল; কিন্তু স্বপ্নও ছিল। সামনে একটি স্বপ্ন ছিল। সমষ্টিগত এবং মস্তবড় স্বপ্ন। আমরা আশা করতাম হানাদারদের তাড়িয়ে দেবো, আমরা মুক্ত হবো, আর সেই লক্ষ্যে আমরা কাজও করতাম। যে যেভাবে পারি কাজ করতে চাইতাম।

ওই যে চিন্তা-ভাবনা করা, স্বপ্ন দেখা, দুঃস্বপ্নে শিউরে ওঠা—এসব এখনো চলছে; কিন্তু সমষ্টিগত স্বপ্নটি এখন আর নেই। সবার মুক্তির কথা এখন আমরা আর ভাবি না; ব্যস্ত থাকি নিজেরটি নিয়ে। আমার কী হলো, আমি কী পেলাম—হিসাব এখন সেটিরই। একাত্তরেও নিজের কথা যে ভাবতাম না, তা তো নয়। অবশ্যই ভাবতাম; কিন্তু সেই দুঃস্বপ্নের কালে এটি জানা ছিল আমাদের, আমাদের ব্যক্তিগত মুক্তি সবার মুক্তির সঙ্গে যুক্ত। দেশকে যদি হানাদারমুক্ত না করা যায়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কেউ-ই বাঁচবো না। তাই বাঁচার লড়াইটি সর্বজনীন লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবাই এক যে জায়গায় ছিলাম, তা তো নয়। দেশের ভেতরে ছিলাম। ছিলাম আমরা দেশের বাইরে; কিন্তু যেখানেই থাকি, চিন্তা ছিল ওই একটিই, কবে মুক্ত হবে এবং কীভাবে তাড়ানো যাবে হানাদার নরঘাতকদের।

তারপর কী ঘটল? বিজয়ের পর আমাদের অভিজ্ঞতাটি কী? তা একেবারেই ভিন্ন রকমের। দেখা গেল, আমরা আলাদা হয়ে গেছি। আমাদের স্বপ্নগুলো ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। আমাদের হাতে সময় নেই সমষ্টিগত স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করার; অথচ সমষ্টিগত কাজ কতো পড়ে রয়েছে! আমাদের দরকার দারিদ্র্য দূর করা। চাই শিল্পে বিনিয়োগ। প্রয়োজন কিঞ্চিৎ মনোযোগী হওয়া। শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। এগুলো সবাই মিলে করার কাজ। কারো একার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়; কিন্তু সবাই যে মিলিতভাবে এসব কাজ করবো, তা তো হচ্ছে না। যা করার, ব্যক্তিগত পর্যায়ে করছি।

সবাই মিলে করবো এমনটা কেন হচ্ছে না তা ভেবে দেখার মতো। ভাবতে গেলে মনে হয় কূল-কিনারা নেই। আমরা দোষ দিই রাজনৈতিক নেতৃত্বের। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে আমাদের মুক্তি এনে দিতে পারেনি, তা অবশ্যই সত্য; কিন্তু দেশটি যে স্বাধীন হয়েছে, তা তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণেই। মুক্তির যে আন্দোলন, তাকে তারাই গড়ে তুলেছেন। আমলা, ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীরা নন; স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন—যা করার রাজনীতির লোকজনই করেছেন। তারা যে আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবেন, তা করতে পারেননি। একটি সীমা পর্যন্ত এগিয়েছেন, তারপর তাদের যাত্রা শেষ।

হ্যাঁ, রাষ্ট্র দল হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে যে রাষ্ট্রের অধীনে আমরা বসবাস করতাম, তা ছিল অনেক বড়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রের আয়তনকে আমরা ছোট করলাম। বাংলাদেশ এক সময়ের পদকায়নের তুলনায় আরো ক্ষুদ্রকার একটি রাষ্ট্র বটে। এ রাষ্ট্র নতুন; কিন্তু কতোটা নতুন? বড় সমস্যাটা ওইখানেই। আমরা নতুন রাষ্ট্র পেয়েছি, ব্রিটিশ ও পাঞ্জাবিদের যে রাষ্ট্র ছিল, সেই রাষ্ট্রের কাঠামো এবং চরিত্র যেমন ছিল আমলাতান্ত্রিক, স্বাধীন বাংলাদেশও সেই রকমেরই আমলাতান্ত্রিক রয়ে গেছে। বদলায়নি। সেই একই আইন-আদালত, নিয়ম-কানুন, প্রশাসন, বিভিন্ন রকমের বাহিনী এখনো রয়ে গেছে।

আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা থাকে সরকারি আমলাদের হাতে। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলারাই ছিল সর্বেসর্বা। পাকিস্তান আমলেও আমলারাই রাষ্ট্র শাসন করেছে এবং তাদের সামরিক আমলারাই পূর্ববঙ্গে গণহত্যা ঘটিয়েছে। বাংলাদেশেও আমরা বার বার সামরিক শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জরুরি অবস্থা ইত্যাদি পেয়েছি। রাজনৈতিক নেতারা যখন দেশ শাসন করেছেন বলে মনে হয়েছে, তখনো ক্ষমতার চাবিকাঠি আমলাদের হাতেই ছিল।

আমলাতান্ত্রিক সরকার কখনোই গণতান্ত্রিক হতে পারে না, হয় না, হওয়ার উপায় নেই। গণতন্ত্রের জন্য চাই জবাবদিহিতা। আমলাতন্ত্রের জন্য কোনো জবাবদিহিতার বালাই থাকে না। গণতন্ত্রে ক্ষমতা ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব ক্ষমতা চলে যায় কেন্দ্রে। গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের শাসন থাকে, আমলাতন্ত্রে শাসন করে সরকারি কর্মচারীরা। আমলাতন্ত্র দেশের স্বার্থের কথা ভাবে না, ভাবে নিজেদের স্বার্থের কথা।

রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতাটা এখানে, তারা পুরনো আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ভেঙে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তারা রাষ্ট্র শাসনের ক্ষমতা পেয়েছেন এবং তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছেন। যদিও তারা অচিরেই টের পেয়েছেন, ক্ষমতার আসল নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে আমলাদের হাতে। তারা ভেবেছেন একসূত্র হতে পেরেছেন। জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পরে মালিকানা যে জনগণের হবে, এ কাজে বিন্দুমাত্র উৎসাহ তাদের ছিল না, এখনো নেই।

যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা আমরা বলছি, তা অন্য কিছু নয়, একটি শাসক শ্রেণি বটে। বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী শাসক শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা দেশের মানুষের উন্নতি চায় না, উন্নতি চায় নিজেদের। এ শাসক শ্রেণিই ভিন্ন নামে দেশের শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং আমলাদের সাহায্যে দেশকে শাসন করে। তাদের মধ্যে ঝগড়া-কলহ আছে, এসব কলহ মাঝে মধ্যে অত্যন্ত কুৎসিত আকার ধারণ করে। ঝগড়া-কলহটা আদর্শ নিয়ে নয়। আদর্শের ব্যাপারে তারা এক ও অভিন্ন। তারা লুণ্ঠন করতে চায় এবং লুণ্ঠনকারীদের মধ্যে যে ধরনের সংঘর্ষ বাধে, তা-ই আমরা তাদের মধ্যে ঘটছে দেখতে পাই। রাজনীতির মূল ধারাটিই হচ্ছে ভাগাভাগির লড়াই।

আদর্শের কথা বলছিলাম। ওই আদর্শের একটি নাম আছে। বিশ্বজুড়ে যা পরিচিত, তা হলো পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে যে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তা উৎপাদনে আগ্রহী নয়, আগ্রহী লুণ্ঠনে। অপরদিকে পুঁজিবাদের যেসব দোষ, তা সবই আমাদের প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হচ্ছে। যেমন: ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখা এবং ভোগবিলাসে মত্ত হওয়া। একাত্তরে এটি ছিল না। একাত্তরে সবার স্বার্থ এক হয়ে গিয়েছিল এবং ভোগবিলাসের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। মানুষের চিন্তা ছিল কীভাবে দেশকে মুক্ত করা যায় তা নিয়ে, উৎসাহ ছিল আত্মত্যাগে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। সেই চেতনাটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক, যার মূল কথাটি হচ্ছে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে ওই সাম্যটা গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রটি তো কোনো একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তা বিস্মৃত ছিল দেশব্যাপী। দেশব্যাপী কেন বলছি, লড়াইটি তো বিদেশেও চলেছে, যাতে জড়িত ছিলেন প্রবাসীরাও।

যুদ্ধের পর পুঁজিবাদী আদর্শ ফিরে এসেছে। ওই আদর্শেই ব্রিটিশের রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে, পাকিস্তানিরাও ওই আদর্শেই দীক্ষিত ছিল, এখন বাংলাদেশের শাসনকর্তারাও পুঁজিবাদী আদর্শের আশ্রয়েই রয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রের আদর্শ তো বটেই, সমাজের আদর্শও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে, বদলায়নি।

আমাদের জন্য প্রথম যা দরকার তা হলো কাজ। মানুষ কাজ চায়। এ দেশের মানুষ মোটেই অলস নয়, তারা কর্মী। দুর্যোগপীড়িত এলাকায় ত্রাণকর্মীরা যখন যান, তখন তারা শোনেন সেখানকার মানুষ বলছেন, ত্রাণ দিচ্ছেন ভালো; কিন্তু আমাদের দরকার কাজ। মঙ্গাপীড়িত মানুষজনেরও ওই একই কথা—কাজ চাই। দেশজুড়ে আজ কাজের জন্য হাহাকার। কাজের সন্ধানে মানুষ উন্মাদের মতো দেশ-বিদেশে ছোটাছুটি করছে, বিদেশে গিয়ে সেখানে স্থানীয় মানুষ যে কাজ করতে চায় না, তেমন কাজ লুফে নিচ্ছে। অথচ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবার ব্যাপারে আমাদের শাসক শ্রেণির বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সরকার আসে সরকার যায়, দুর্নীতি বাড়ে; কিন্তু কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পায় না।

কাজ বাড়াতে হলে বিনিয়োগ চাই। বিনিয়োগের জন্য পুঁজি দরকার। পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারেন ধনীরা; কিন্তু বাংলাদেশের ধনীরা বিনিয়োগে আগ্রহী নন। তারা যে কলকারখানা গড়ে তুলবেন; কৃষি, মৎস্য চাষ, বনায়নে টাকা খাটাবেন—এমন উৎসাহ দেখা যায় না। তারা ঝুঁকি নিতে চান না, চান লুণ্ঠন করতে। এদিকে আমলাতান্ত্রিক এই রাষ্ট্র যে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করবে, তাও করছে না। কেননা আমলারা ঘুষ বোঝেন, কর্মসৃষ্টি বোঝেন না।

পুঁজিবাদ আরেকটা মারাত্মক ঘটনা ঘটায়। তা হলো বৈষম্য বৃদ্ধি। ধনীকে সে আরো ধনী করে, গরিবকে করে আরো গরিব। বাংলাদেশের গত বায়ান্ন বছরের ইতিহাস এই বৈষম্য বৃদ্ধির ইতিহাস। একাত্তরের চেতনা যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, বৈষম্য বৃদ্ধি তাকে পদে পদে দলিত-মথিত করেছে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তো রয়েছেই, বৈষম্য বেড়েছে নারী-পুরুষের অবস্থানের ক্ষেত্রেও। কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা যখন ভালো করছে, শিল্প ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি আগের সব মাত্রা লঙ্ঘন করেছে; কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি। মর্যাদাও যে বেড়েছে তা বলা যাবে না।

একাত্তরের গৌরব ছিল দেশপ্রেম। সেই দেশপ্রেম এখন অনেক কমে গেছে। কারণ পুঁজিবাদী আদর্শের অপ্রতিহত দৌরাত্ম্য। প্রত্যেকেই যদি কেবল নিজের কথাই ভাবেন, তাহলে দেশের কথা ভাববেন কে? কিন্তু ভাবতে তো হবে! দেশ না থাকলে তো আমরা নেই। কেবল যে পরিচয় বিলীন হয়ে যাবে তা নয়, দাঁড়ানোর জায়গাটিও থাকবে না। আমরা শ্যাওলার মতো ভাসতে থাকবো।

ভাবলেই চলবে না, কাজও চাই। সবচেয়ে বড় কাজটা হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করা। কারা করবেন চিন্তা-ভাবনা এবং যোগ দেবেন এ কাজে? দেবেন তারাই যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক। তাদের সংখ্যা কম নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি তো একদিনে গড়ে ওঠেনি, তা আছে এবং থাকবেও।

এই ব্যাপারে আমাদের সময় দেয়া দরকার। নইলে বিপদ বাড়বে, এখন যেমন বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। আমরা সময় দেবো কি? এই দেয়া না-দেয়ার ওপরই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। অনেক কাজই জরুরি। তবে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে দেশকে গণতান্ত্রিক করা, তা ভুললে চলবে না।

Comments