প্রথম বিদ্রোহ পিতার বিরুদ্ধে

লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৩ জুন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। ওই বক্তৃতায় উঠে আসে তার মা-বাবার স্মৃতি, শৈশব কৈশোরের দিনগুলোর বর্ণনা, শিক্ষা ও সাহিত্য জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। সবমিলিয়ে তার এই বক্তৃতা যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

এই শিক্ষাবিদের দেওয়া আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো ৭ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন ইমরান মাহফুজ, খালিদ সাইফুল্লাহ ও মোহাম্মদ আবু সাঈদ। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর তৃতীয় পর্ব।

আমাদের মেয়েরা যখন বেরোতেন তখন রিকশা বা ঘোড়ার গাড়ি কাপড় দিয়ে ঢেকে বেরোতে হতো। কিন্তু, বোরখা পরে আমরা দেখিনি যে মেয়েরা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করছে। আমার স্ত্রী নাজমা জেসমিন; সে সেন্ট্রাল উইমেন্স- এ তখন পড়ায়। সে যাচ্ছে হাটখোলাতে। আমি গ্রামে। সে বাবার বাড়িতে থাকে। বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে এবং মায়ের বোরখা খুঁজে বের করে বোরখা পরে যাচ্ছে।

আর বোরখার ঘটনা সম্বন্ধে নাজমা খুব বলিষ্ঠ ছিল তার মায়ের সাথে। আগে একবার তারা যাবে রিকশা করে। মা অস্থির হয়েছেন, বোরখা খুঁজে পাচ্ছেন না। নাজমা কথাবার্তার ব্যাপারে বেশ স্পষ্ট, তুখোড় ছিল। নাজমা বলছে, 'তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন? লোকে তো আমার দিকে তাকাবে।' সেই নাজমা তখন মায়ের বোরখা পরে বেরিয়েছে। এবং একটা অপমান, একটা লজ্জা তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল।

সেই বোরখা, হিজাব এখন কেমনভাবে এসেছে আপনারা দেখেছেন। এবং নাজমাকে দেখতাম প্রত্যেকদিন সকালে উঠে কপালে একটা টিপ পরতো। টিপ পরা নিয়ে মোনেম খান খুব উল্টাপাল্টা কথা বলত। কিন্তু, বাংলাদেশ হওয়ার পরে তো আমি দেখছি তেজগাঁও কলেজের এক প্রফেসর টিপ পরার কারণে পুলিশের একজন লোক তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। এই পরিবর্তনগুলো সামনে থেকে আমরা দেখলাম।

আরেকটা কথা বলি। সেটা হচ্ছে আমাদের বাসাতে পাকিস্তান আমলে দোলার মা কাজ করত। দোলার মা থাকতো রেললাইনের পাশে বস্তিতে, তার ছেলে রিকশা চালাত। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে আমরা বাসায় ফিরে এসেছি। আগের তুলনায় বড় বাসা পেয়েছি এইটা আমাদের উন্নতি। দোলার মা আবার আমাদের বাসায় চাকরি পেল।

আমাদের বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তার কাছে ছিল। বাজার করত, রান্না করত। তো একদিন দোলার মা বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তার কোমরের আঁচল থেকে হঠাৎ করে পেঁয়াজ, রসুন, আলু, আদা এগুলো পড়ে গেল। তো দোলার মা যে লজ্জা পেল, সেটা অবর্ণনীয়। দোলার মা লজ্জায় আর ফেরত আসেনি আমাদের বাড়িতে। কয়েক মাস পরে দোলার মা এসেছে, হাউমাউ করে কাঁদছে।

কী ব্যাপার? বলল, ছেলে মারা গেছে। এবং তখন আমরা তাকে একটু সাহায্য করলাম। এটা হলো তখনকার বাংলাদেশের ছবি- আমরা দেখলাম। এই ছবিগুলো খুব সত্য। আরেকটা সত্য হলো যে, ৪৭ সালে প্রথম আমরা যখন স্বাধীন হলাম, একটা দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা। রেশন কার্ড খুব একটা জরুরি ব্যবস্থা। পঁচা চাল, দুর্গন্ধযুক্ত গম সেগুলো নিয়ে কলে ভাঙাতে হতো।

আবার যখন ৭১ সালে স্বাধীন হলাম, আবার দেখি সেই দুর্ভিক্ষ, সেই রেশন কার্ড। তেল পাওয়া যাচ্ছে না, কেরোসিন তেলের ভয়ঙ্কর অভাব। তো এইভাবে হলো পরিবর্তনটা।

আর আমার লেখাপড়া সম্বন্ধে আপনারা শুনেছেন। আমার বাবা আমার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। কী করব, কী পড়াশুনা হবে?  তার আবার দারুন আগ্রহ ছিল মিশোনারি স্কুলে। রাজশাহীতে মিশনারি স্কুল পাননি। কলকাতাতে একটা মিশনারি স্কুল পেলেন। সেখানে নিয়ে ভর্তি করে দিলেন।

ঢাকায় মিশনারি স্কুল হয়েছে সেন্ট গ্রেগরি। আমাদের দুই ভাইকে সেখানে ভর্তি করে দিলেন। আমরা ভর্তি হয়ে গেলাম, পাস করে বেরোলাম। তারপর কলেজে ভর্তির সময় ঢাকা কলেজে ভর্তি হব। ফর্ম এনেছি। তখন আমার বাবা বললেন, তোকে তো সেন্ট গ্রেগরি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছি। সেন্ট গ্রেগরি কলেজ তখন মাত্র হয়েছে।

এইটা আমরা দ্বিতীয় ব্যাচ, প্রথম ব্যাচে অল্প কয়েকজন। কিন্তু খুব সকালে, প্রত্যুষে ক্লাস হয়। যেখানে আমরা ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে ক্লাস করেছি। তো আমার মন খুব ভেঙে গেল। তারপর কলেজ অবশ্য লক্ষীবাজারে গেল। কিন্তু, এইখানে দুজন শিক্ষককে আমি পেয়েছিলাম। একজন হচ্ছেন অজিত কুমার গুহ। তিনি জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক ছিলেন এবং এখানে আমাদের খণ্ডকালীন হিসেবে পড়াতেন। এবং পড়ানো যে এত অসাধারণ হতে পারে, আবৃত্তি যে এত অসাধারণ হতে পারে, মাইকেলের কবিতায় যে এত মাধুর্য আছে, এগুলো আমরা তার কাছে থেকে জানলাম।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হলো, আন্দোলনে আমরাও ছিলাম। সে আরেকটা কাহিনী। অজিত কুমার গুহ গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। আমি গেছি কলেজে অ্যাডমিট কার্ড আনতে। তো ফাদার মার্টিন, তিনি খুব অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। তার বয়স তখন হয়তো ৩০ হবে। ঘটনাটা আমি বলছি, ফাদার মার্টিন সম্বন্ধে জানানোর জন্য। তিনি ভাইস প্রিন্সিপাল। কিন্তু কলেজ তিনিই চালান। ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। এবং তিনি টেম্পেস্ট নাটকটা মঞ্চস্থ করলেন। একেবারে মূল নাটক। আমরা অল্প কয়েকজন ছেলে সেটাতে অভিনয় করলাম। তিনি চরিত্র ভাগ করে দিলেন। আমি করলাম ক্যালিবানের চরিত্র।

তো আমরা সবাই মিলে নাটকটা করলাম, এখন মেয়ে কোথায় পাওয়া যাবে? স্কুলে তো সবাই ছেলে। তো আমাদেরই এক সহপাঠী, তাকে মেয়ে সাজানো হলো। এভাবে নাটক অভিনীত হলো, চমৎকার নাটক হলো। একদিন হওয়ার কথা ছিল, দুদিন হলো। এবং ক্যালিবানের ভূমিকায় আমি নাকি খুব ভালো করলাম। আমি যে চিৎকার করে বলেছি, আমি যে অভিশাপগুলো দিয়েছি সেগুলো এখনো আমার কানেও বাজে। তো এই হচ্ছে ফাদার মার্টিন।

যে কথাটা বলছিলাম, আমি গিয়েছি অ্যাডমিট কার্ড আনতে। ফাদার মার্টিনের সাথে দেখা হয়েছে। আমি বলছি যে, অজিত স্যারকে তো ধরে নিয়ে গেছে। ফাদার মার্টিন বললেন, 'তুমি জানো?' আমি বললাম, 'কী?' ফাদার বললেন, 'উনি একজন কমিউনিস্ট।' তো আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলাম যে, এ তার (অজিত কুমার গুহ) সহকর্মী! একসাথে পড়ান, তার পরিচয় এখন দাঁড়িয়েছে যে তিনি একজন কমিউনিস্ট! সে জেলে আছে এটা যেন একটা ভালো ঘটনা।

ওই মুহূর্তে আমি বুঝেছি যে, আমেরিকানরা যে যাই হোক, কমিউনিস্টরা তাদের কাছে প্রেতাত্মা। এটা ফাদার মার্টিনের এই ঘটনা থেকে আমি বুঝলাম। যাই হোক, ফাদার মার্টিন যখন মারা গেলেন, তখন আমি ইংল্যান্ডে এবং তার মৃত্যুতে আমি খুব মর্মাহত হলাম।

তারপরে আমি তো পাস করলাম। পাস করে তখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বছরে। কিসে পড়ব, কী পড়ব? আবার বাবা ঠিক করে রেখেছেন যে ইকোনোমিকস পড়তে হবে এবং তিনি বুঝে ফেলেছেন যে, এই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী। এখানে ইকোনমিকস পড়া খুব মুনাফা আনবে।

দ্বিতীয়ত, তার এবং সব পিতারই তখন আকাঙ্ক্ষা যে, ছেলেটা সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দেবে এবং সিভিল সার্ভেন্ট হবে। তারই প্রস্তুতি হিসেবে তিনি ইকোনোমিকস ঠিক করে রেখেছেন। আমি ইকোনোমিকসের সিলেবাস দেখলাম রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে। সেখানে দেখলাম যে এটা ম্যাথমেটিকস এবং স্ট্যাটিসটিকসে ভরপুর। ইকোনোমিকস তখন ওইরকম ছিল।

আমার কাছে ওই ইকোনোমিকস মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। ইকোনোমিকসকে আমি সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। আর অংক আমি পারব না। আমার বন্ধুরা খুব উৎফুল্ল। তারা আইএসসি পাশ করে এসেছে, অংক পারে।

আমি গো ধরলাম যে, আমি ইকোনোমিকস পড়ব না। তাহলে তুমি কী পড়বে? আমি বললাম যে আমি সাহিত্য পড়ব। বলতে পারলাম না যে, আমি বাংলা সাহিত্য পড়ব। বাংলা সাহিত্য পড়ব বললে উনি বলতেন, তুমি তো ঘরের মধ্যেই এটা পড়তে পারো। তো যাই হোক, তারই কম্প্রোমাইজ হলো। উনি বললেন যে, তুমি তাহলে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ো।

কিন্তু তোমাকে ইকোনোমিকস এবং পলিটিক্যাল সায়েন্স সাবসিডিয়ারি পড়তে হবে। ওই যে সিভিল সার্ভিসে যেতে হবে, সেইখানে যাওয়ার প্রস্তুতি। তো এই আমার প্রথম বিদ্রোহ পিতার বিরুদ্ধে এবং পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago