রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে হবে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাংলাদেশ যত উন্নতি হচ্ছে তত বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্যের কারণে মানুষের যে বিক্ষোভ, তা প্রকাশের পথ পাচ্ছে না। এটা একটা সত্য। দ্বিতীয় সত্য হলো, দেশে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তিন ধারার মধ্যে দুই ধারা- ইংরেজি ও মাদ্রাসা। দু'টি কৃত্রিম, অসম্পূর্ণ এবং দু'টির মধ্যেই মাতৃভাষার চর্চার অভাব। দু'টিই আমাদের স্থানীয় ইতিহাস, পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। ওদিকে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে থাকতে তরুণরা বিক্ষুব্ধ। শুধু তরুণ নয়, সব মানুষই বিক্ষুব্ধ।

আবার লাখ লাখ মাদ্রাসার তরুণরা নিজেদের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কাজেই তাদের রাগ আছে এই গোটা ব্যবস্থার ওপর। ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেরাও দেখতে পাচ্ছে তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তারা যে সৃষ্টিশীল, দুঃসাহসী, বীরত্বপূর্ণ কাজ করতে চায় সেটা তারা পাচ্ছে না।

মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার মূল মিল হলো উভয়েই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। পুঁজিবাদী সমাজ এমনিতেই মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, আবার এই দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কাঠামোর কারণে আরেক ধরনের বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হয়। এই তরুণদের মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়- হতাশার ও মাদকাসক্তির। বিচ্ছিন্নতাবোধ দারুণভাবে কাজ করে। কেউ কেউ সবকিছু ছেড়ে ধর্মের দিকে চলে যায়। ধর্মের দিকে যাওয়াকে সামাজিকভাবে উৎসাহিত করা হয়। ছেলেটা মসজিদে গেলে মা-বাবা অনেকটা নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত বোধ করেন। কারণ মসজিদে না গেলে সে হয়তো ড্রাগ নেবে বা বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে।

আরেকটি মনস্তত্ত্বও এখানে কাজ করছে। তা হলো এই তরুণদের কাছে বাঙালি পরিচয় এখন লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন আর তেমনভাবে কাজ করছে না। আর বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তো এই প্রশ্নটি বরাবরই ছিল যে সে আগে বাঙালি, না আগে মুসলমান! বহু তরুণ নিজের মধ্যে বাঙালিত্বের চেয়ে মুসলমানিত্বকে বড় করে দেখতে পাচ্ছে। কারণ এতে আন্তর্জাতিকতা আছে। মুসলমান পরিচয়ের একটা গর্ব থাকে। তাছাড়া সে বাঙালির ইতিহাস জানে না। ফলে মুসলমানদের ইতিহাসই তার কাছে বড় বলে মনে হচ্ছে।

ইন্টারনেট, ফেসবুক এসবের মাধ্যমেও সে জঙ্গি ভাবধারায় জড়িয়ে পড়ছে। অথচ এই তরুণেরাই একাত্তরে যুদ্ধে গেছে। তরুণদের মধ্যে বিদ্রোহের, বীরত্বের অনুশীলনের যে আকাঙ্ক্ষা সেটা সব সময় কোথাও না কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়তে তাকে অনুপ্রাণিত করে। এখন তার সামনে পথ খোলা নেই, তাই দেখা দিচ্ছে হতাশা ও অপরাধ-প্রবণতা।

স্বাধীনতার জন্য আমরা একাত্তরে লড়াই করেছি। এর আগে ব্রিটিশ আমলেও লড়াইটা ছিল। স্বাধীনতার অর্থ কী ছিল? স্বাধীনতার অর্থ সবার কাছে এক ছিল না। জাতীয়তাবাদীদের কাছে স্বাধীনতার যে অর্থ সমাজতন্ত্রীদের কাছে সেটা ছিল না। জাতীয়তাবাদীরা ছিল সুবিধাপ্রাপ্ত। তারা স্বাধীনতা চেয়েছিল নিজেদের সুবিধা আরও বাড়ানোর জন্য। পাকিস্তানের পতনের পরেও সুবিধা পেয়েছে সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগকারীরাই। আর সমাজতন্ত্রীদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল মুক্তি। তারা চেয়েছে শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি শোষণমুক্ত, নির্যাতনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল, কিন্তু তাঁদের ভয় ছিল সাম্যের। কারণ সাম্য এলে রাষ্ট্র কাঠামোটি ভেঙে পড়বে।

তাঁরা যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো যদি সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তাহলে তাঁদের ভাগে টান পড়বে। আসলে জাতীয়তাবাদী নেতারা মনে করতেন, বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে গেলে তাঁরা কিছুই পাবেন না। তাঁদের সব সুযোগ-সুবিধা হারিয়ে যাবে। কাজেই তারা সাম্যকে খুব ভয় করে। এই ভয় আদতে মেহনতি মানুষকে ভয় করা। পুঁজিবাদ থাকলে তারা নিশ্চিত থাকে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির। স্বাভাবিকভাবেই সেটাই তারা চেয়েছে। তাদের ভয় মেহনতি মানুষের জেগে ওঠাকে।

তাঁরা যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো যদি সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তাহলে তাঁদের ভাগে টান পড়বে। আসলে জাতীয়তাবাদী নেতারা মনে করতেন, বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে গেলে তাঁরা কিছুই পাবেন না। তাঁদের সব সুযোগ-সুবিধা হারিয়ে যাবে। কাজেই তারা সাম্যকে খুব ভয় করে। এই ভয় আদতে মেহনতি মানুষকে ভয় করা। পুঁজিবাদ থাকলে তারা নিশ্চিত থাকে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির। স্বাভাবিকভাবেই সেটাই তারা চেয়েছে। তাদের ভয় মেহনতি মানুষের জেগে ওঠাকে।

আমরা একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের কথা বলি, দুই লাখ নারী নিপীড়িত হওয়ার কথা বলি। তাদের অধিকাংশই ছিল মেহনতি মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার কোনো সুফল মেহনতিরা পেল না।

জাতীয়তাবাদীরা শাসক হয়ে রাষ্ট্রকে একটুও বদলালো না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক কোনো পরিবর্তনই ঘটালো না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শাসকদের যে চরিত্র তাদেরও তেমন চরিত্র। তারা পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটালো। তারা অবাধ স্বাধীনতা পেল, যে স্বাধীনতা তারা আগে কখনো পায়নি। তারা ছোট বুর্জোয়া থেকে বড় বুর্জোয়া হলো। পুঁজিবাদের অনেক ভালো দিক আছে। এখানকার বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদের সৃষ্টিশীলতাকে, সহনশীলতাকে (আপেক্ষিক অর্থে) ধারণ করে না। তারা কেবল লুণ্ঠন করতে চায়। দেশের সম্পদ তারা বিদেশে পাচার করে, তারা উৎপাদন বৃদ্ধি করে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না। এটাই তাদের প্রবণতা। এ জন্যই কোনো কিছুর বদল হলো না।

একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি সামাজিক অবস্থান ছিল, তাদের শিকড় ছিল। একাত্তরে সেটা উৎপাটিত হয়েও হয়নি। অনুকূল আবহাওয়াতে এখন তাদের কাছে বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে মুসলমান পরিচয় বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তির তো একাকী বড় হবার ক্ষমতা নেই। তাদের ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে মানুষের ব্যর্থতার বোধ থেকে, মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়ন থেকে।

নিপীড়িতরাই তো আন্দোলন করবে, সমাজ পরিবর্তনের ডাক দেবে। দক্ষিণপন্থিরা তো সেটা করবে না। তারা সব সময়ই বিদ্যমান ব্যবস্থা রক্ষা করবে। ১৯৭১ সালের পর থেকে দেশে বাম আন্দোলন অত্যন্ত দুর্বল হতে থাকলো। এর প্রধান কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা জাতীয়তাবাদীদের হাতে চলে গেছে, এবং তারা সমাজতন্ত্রীদেরকে নিপীড়ন করেছে। আর একটি বড় ভূমিকা মিডিয়ার। মিডিয়া কোনোভাবেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সহ্য করতে পারে না। মিডিয়ার মালিকেরা তো নিপীড়নকারীদের দলেরই লোক। দক্ষিণপন্থিদের শক্তিবৃদ্ধির তৃতীয় কারণ হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। এসব কারণে বাম আন্দোলন এগুতে পারলো না।

নিয়ম তো এটাই যে, মানুষের বিক্ষোভ হয় ডান দিকে যাবে, নয় তো বাম দিকে। বাম দিকের রাস্তা বন্ধ। ফলে ডান দিকে যাচ্ছে। আর এই ডান দিকটাই হলো প্রতিক্রিয়াশীল রাস্তা। সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা যেহেতু প্রগতির দিকে গেল না, আলোর দিকে যেতে পারলো না, যেহেতু সেটা অন্ধকারের দিকে চলে গেছে। জঙ্গিবাদও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। জঙ্গিবাদীরা জানে না তারা কী করছে। তাদের মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার চিন্তা এসেছে; যদিও তারা বলতে পারবে না খিলাফত জিনিসটা কী। আদতে খিলাফত হলো ব্যক্তি মালিকানাধীন-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাদের বিরোধ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে। এবং আত্মীয়তা পুঁজিবাদের সঙ্গে। এর মূলে আছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা রক্ষার ধারণা।

খিলাফতী এবং পুঁজিবাদীদের ভেতর যে সংঘর্ষ, তা আসলে সীমিত; অনেকটা পারিবারিক ঝগড়ার মতোই। এঘর-ওঘরের সম্পর্ক। যে কোনো সময়ে তারা এক হয়ে যেতেও পারে। সমাজতন্ত্রীরা এখন যেহেতু মাঠে নেই, কাজেই সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা রক্ষাকারী দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে বিবাদ করছে। আগের কালে তারা উভয়েই সমাজতন্ত্রীদের ওপর নাস্তিক বলে ঝাঁপিয়ে পড়তো। মূল বিষয় হলো জঙ্গিবাদীরা পুঁজিবাদের ধারক, পুঁজিবাদের মধ্যে যে যে বিকৃতিগুলো আছে তারা তা ধারণ করে। এরা পিতৃতান্ত্রিক, ভয়াবহ রকমের নারীবিদ্বেষী। ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি ঘটনায় এটা আরও পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এরা স্থানীয়ভাবে বিকশিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে পুষ্ট হচ্ছে।

তবে বলপ্রয়োগ করে এদেরকে দমন করা যাবে না। কেননা বলপ্রয়োগ পাল্টা বলপ্রয়োগের সৃষ্টি করবে। এরা তো আত্মঘাতী। মানুষের মধ্যে আদর্শের জন্য বলিদানের একটা প্রবণতা থাকে, কিন্তু জঙ্গিদের প্রাণদানের সঙ্গে সম্পর্কটা মুনাফার। পুঁজিবাদ যেভাবে মুনাফায় বিশ্বাস করে তারাও সেই ভাবেই মুনাফার আশা রাখে। তারা মনে করে পরলোকে গিয়ে চিরকালের জন্য সুখ-শান্তিতে থাকবে। তারা এখানে কষ্ট করছে, ওখানে গিয়ে ফল পাবে। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও এভাবে ভাবছে। ভাবনাটা একেবারেই ব্যক্তিগত স্বার্থকেন্দ্রিক। যদিও মনে হবে তারা ধর্মের জন্য লড়াই করছে, আসলে কাজ করছে নিজের জন্য।

কিন্তু মূল ক্ষমতা যেহেতু রাষ্ট্রের; সুতরাং রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তবে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তো সে দায়িত্ব নেবে না। সে জন্য রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। এর জন্য যে সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা নেয়া আবশ্যক। মানুষ সংস্কৃতির মধ্যেই বসবাস করে। এখন এই সংস্কৃতির চর্চা সচেতনভাবে বাড়ানো চাই।

সংস্কৃতি-চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের পিছু হটার একটা খুব ছোট কিন্তু জরুরি দৃষ্টান্ত এই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন কোনো ছাত্র সংসদ নেই। ৩৩ বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের কোনো নির্বাচন নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নেই-ই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা অধিকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করবে, নাটক করবে, বিতর্ক করবে, গান করবে, আবৃত্তি করবে, তারা মত প্রকাশ করবে, পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করবে, সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেবে, তারা লিখবে। আমরা তাদের এসব কাজের সুযোগ দিতে পারছি না। তারা অন্ধকারে গিয়ে নিজের মতো করে মতাদর্শ খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশটাও নেই। জ্ঞানের অনুশীলন কমে গেছে। জ্ঞানই তো শক্তি।

Comments

The Daily Star  | English
Gen Z factor in geopolitics

The Gen Z factor in geopolitics and the Bangladesh-US dynamics

Gen Z should keep in mind that the US cannot afford to overlook a partner like Bangladesh given the country’s pivotal position in South Asia’s economic landscape.

10h ago