ঠিক পথে এগোচ্ছেন তো ইমরান খান

ইমরান খান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) গত সপ্তাহে পাঞ্জাব গণপরিষদের উপ-নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয় পেয়েছে। পাঞ্জাব গণপরিষদের ২০ আসনে ওই উপ-নির্বাচন হয় এবং ১৫টিতে পিটিআই বিজয়ী হয়। এতে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও প্রকট হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের জন্য এই পরাজয় একটি বড় ধাক্কা। প্রায় ২ মাস আগে তার ছেলে হামজা শেহবাজ গণপরিষদে পিটিআই প্রার্থীকে পরাজিত করে প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। পিটিআইয়ের এই জয় যেন ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জোটের রাজনৈতিক দুর্দশার প্রতিচ্ছবি।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে পাঞ্জাবের উপ-নির্বাচন। তারা মনে করেন, ইমরান খানের দলের এই উত্থান বিরোধীদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন করে তুলবে।

এর আগে, গত মার্চে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিরোধীরা। যদিও ইমরানের অভিযোগ, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। তিনি এ ঘটনার জন্য পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বকে আক্রমণ করে আসছেন। ইমরানের এই অভিযোগকে শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

পাঞ্জাবের গণপরিষদের উপ-নির্বাচনে হেরে যাওয়ার একদিন পর পিএমএল-এনের এক জ্যেষ্ঠ নেতা দাবি করেন, তাকে দল থেকে 'হুমকি' দিয়ে বলা হয়েছিল- তিনি যদি ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব না আনেন তবে অন্য কাউকে ওই পদে বসানো হবে।

পিএমএল-এনের এই আইনপ্রণেতা ইমরানবিরোধীদের চিন্তার কারণ হিসেবে ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদের কথা উল্লেখ করেন। তাকে ইমরান খানের সরকার আগামী নভেম্বরে পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করতো বলে মনে করা হয়েছিল।

সম্ভবত তখনকার বিরোধী দল পিএমএল-এন ও পিপিপি ফয়েজ হামিদের সেনাপ্রধান হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তারা সম্ভাব্য ফলাফলের দিকে মনোযোগ না দিয়ে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরানের সরকারকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

অনাস্থা ভোটের সিদ্ধান্ত শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ও সামরিক বাহিনীর বর্তমান নেতৃত্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর প্রমাণ যেন পাঞ্জাবের উপ-নির্বাচন। বলতে গেলে ইমরান শুধু সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাই নয়, বরং তিনি দেশের জনগণের কাছে তার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও 'মার্কিন হস্তক্ষেপে'র বিষয়টিকেও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।

পাঞ্জাবে তাকে হারানোর মতো কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি বিরোধীরা।

বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ইমরান খানের অভিযোগ পাকিস্তানের মানুষ খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন এবং তারা পিটিআইকে সমর্থন করছেন। দল থেকে বের হয়ে যাওয়া নেতাদের উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেননি ইমরান খান। যা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার উজ্জ্বল প্রমাণ।

এটি এখনো স্পষ্ট নয় যে—সেনাবাহিনী উপ-নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল না কি ইমরান খানের কৌশল ও আক্রমণাত্মক ভূমিকার কারণে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

ঘটনা যাই হোক না কেন, ইমরান খান সেখানে চূড়ান্ত বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং আবারও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে এগিয়ে আছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

উপ-নির্বাচনে জয়ের পর এক ভাষণে ইমরান খান তার কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবির পাশাপাশি তাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। তার সরকারকে উৎখাত করতে আবারও 'বিদেশি ষড়যন্ত্রে'র মাধ্যমে বিরোধীদের ক্ষমতায় আসার অভিযোগ করেন। একইসঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটাতে আগাম নির্বাচনের আহ্বান জানান।

পাঞ্জাবে জয়ের পর বলাই যায়, ইমরানের পিটিআই হয়তো ঠিক পথেই এগোচ্ছে। তিনি হয়তো সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়াই ক্ষমতায় ফিরে আসার পরিকল্পনাও করছেন।

ইমরান খান পরিকল্পনা করলেও এটি তার জন্য মোটেও সহজ হবে না। তিনি পাঞ্জাবের উপ-নির্বাচনে জয়ী হতে পারেন, তবে এর অর্থ এই নয় যে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনেও তিনি জয়ী হবেন। এমনও হতে পারে দেশটির সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব ও তার বিরোধীরা অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের দাবি মেনে নেবে না। তিনি হয়তো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন, কিন্তু তাদের অতিক্রম করা সহজ হবে না।

ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন জোট ঘোষণা করেছে, তারা সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ শেষ করবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিএমএল-এনের জ্যেষ্ঠ নেতা শহীদ খাকান আব্বাসি আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, বর্তমান জোট ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে।

পিএমএল-এন বুঝতে পেরেছে ইমরান খানকে মোকাবিলা করতে হলে তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ টুইটে বলেন, 'আমি পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করছি, তারা যেন পিটিআইয়ের বিদেশি অর্থায়নের বিষয়ে বিলম্বিত রায় ঘোষণা করে।

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের শাসনকে বিদায় করে ইমরান কেন্দ্র শাসন করতে পারবেন কি না। ইমরান যদি পাঞ্জাব ও কেপিতে ফেডারেল সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে অস্বীকার করেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, যেভাবে বিষয়গুলো উন্মোচিত হচ্ছে তাতে এমন কিছু ঘটতেও পারে।

এ দিকে, পাকিস্তানের অর্থনীতি মোটেও ভালো অবস্থানে নেই। আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রার দরের নিয়মিত অবনমন হচ্ছে। স্পষ্টতই, ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর এবং নতুন সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে না পারায় দেশটির অর্থনীতির এই নিম্নমুখী প্রবণতা।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামীতে পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

জোট সরকার হয়তো ইমরান খানকে চাপে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে। কিন্তু, দেশটির অর্থনীতি চরম আকার ধারণ করলে হয়তো আগাম জাতীয় নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। সব পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশ্ন ওঠতে পারে ঠিক পথেই এগোচ্ছেন তো ইমরান খান?

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

11h ago