সিলেটে বানভাসিদের সহায়তা: উদ্যোগের চেয়ে বড় ঘাটতি সমন্বয়ে

সিলেটে ত্রাণবাহী একটি নৌকা ঘিরে ধরেছেন বানভাসিরা। ছবি: স্টার

দুদিন ধরে ৫ মেয়েসহ অভুক্ত সিলেটের গোয়াইনঘাটের মিত্তির মহল গ্রামের শামসুন্নাহারের বারংবার আকুতি ছিল তার নামটা যেন লিখে নেওয়া হয়। তার ধারণা, এতে করে তিনি হয়তো কিছু সহায়তা পাবেন।

শুক্রবার দুপুরের দিকে যখন তার বাড়িঘর প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল, তখন স্বামী-সন্তানসহ পাশের আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে চেঙ্গেরখাল নদীর দূরবর্তী কোনো এক টিলায় আশ্রয় নেন। সেটা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে। সেখান থেকে পানি ভেঙে পাশের সালুটিকর বাজারে এসে অনেকের সঙ্গে গত সোমবার দিগ্বিদিক ছুটছিলেন শামসুন্নাহার। আশা যদি কিছু খাদ্য সহায়তার মেলে।

তাকে যখন বলা হলো, এটা তো মূল বাজার, অনেকেই তো সাহায্য নিয়ে এখানে আসেন। তবুও তিনি পাননি কেন?

শামসুন্নাহার উত্তর- সবাই মনে করে আমরা পাইছি, এজন্য নৌকায় ত্রাণ নিয়ে দূরের এলাকাগুলোতে চলে যায়!

প্রথমে যুক্তিটাকে হালকা মনে হলেও পরে প্রায় ডজন খানেক বানভাসির সঙ্গে কথা বলে একই বাস্তবতার কথা শোনা যায়।

স্থানীয় এক নৌকাচালক জানান, যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, তারা তো জানেন না যে, কোথায় লোকজন পেয়েছে আর কোথায় পায়নি।

সালুটিকর বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘণ্টা তিনেক বিশাল জলরাশির শিয়ালা হাওড় পেরিয়ে জলমগ্ন বৈঠাখালি গ্রামে গিয়েও শামসুন্নাহারের কথার সত্যতা পাওয়া গেল।

স্থানীয় কৃষক তাজউদ্দীন জানান, সেখানে শনিবার রাতে আর রোববার দুপুরে দুটি দল খাবার দিয়ে গেছে। কিন্তু উজানের দিকে কেউ যায় না। তিনি এও জানালেন, সরকারি বরাদ্দ কম থাকায় স্থানীয় চেয়ারম্যান বা মেম্বাররা সবাইকে প্রয়োজনমত সহায়তা দিতে পারছেন না।

গত সোমবার এক নৌকাচালক (যিনি স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের ত্রাণ বিতরণে সারাদিন শিয়ালা হাওড় পেরিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরেছেন) জানান, স্থানীয় প্রতিনিধিরা অপ্রতুল ত্রাণ মূলত কাছের লোকদের দিচ্ছেন। এতে হতদরিদ্ররাই বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন।

সেনাবাহিনী কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে নির্দিষ্ট তালিকা ধরে খাবার দিচ্ছে, কিন্তু তালিকার বাইরের কেউ এই সহায়তা পাচ্ছেন না বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সরকারের তরফে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সিলেট জেলায় ৮১২ টন চাল, শুকনো খাবার ১৩ হাজার ১১৮ প্যাকেট, নগদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছে। সুনামগঞ্জে বরাদ্দ হয়েছে ৭৭০ টন চাল, ১৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়া, মৌলভীবাজার জেলায় ২১০ টন চাল, ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা ও ১ হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং হবিগঞ্জে ৪০ টন চাল, ৫ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সরকারি হিসেবেই সিলেট বিভাগে পানিবন্দি মানুষ কমপক্ষে ৪০ লাখ। ১ হাজার ৪৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ৪ লাখ ৪ হাজার মানুষ। সবার জন্য কি এটা পর্যাপ্ত?

যখন সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন, তখন তাদের সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি যেসব তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো- এসব তৎপরতায় কোনো সমন্বয় নেই, সুষম বন্টনব্যবস্থা নেই।

স্বেচ্ছাসেবী কয়েকটি দলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ত্রাণ নিয়ে কোথায় যাবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।

সুনামগঞ্জের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর মেহেদী হাসান জেলার ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয় করছেন। তিনি আজ সকালে ডেইলি স্টারকে জানান, কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং এরপর তারা তাদের নির্দেশনা দিতে পেরেছেন। কিন্তু সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা বিভাগীয় বা জেলা প্রশাসন থেকে এখনো নেই।

তুমুল বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে রোববার পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ কেউ-ই খুব একটা তৎপরতা চালাতে পারেননি। এখন পানি কমতে শুরু করেছে। তবুও সরকারের তরফে কোনো সমন্বয়ের ঘোষণা আসেনি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ২-৪-৫শ প্যাকেট ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসছে ঠিকই, কিন্তু হাওড়ের দুর্গম এলাকার মানুষ পর্যন্ত সেটা পৌঁছাতে পারছে না। কারণ এই মুহূর্তে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বড় বড় সড়ক ধরে কিছুদূর গিয়ে যেখানে যাদের পাচ্ছে তাদের হাতে সেসব সামগ্রী তুলে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে। এতে কেউ একাধিকবার পাচ্ছেন, আর অধিকাংশ কিছুই পাচ্ছেন না। আর এই পরিস্থিতি এসব মানুষদের বেঁচে থাকাকে আরও কঠিন করে তুলছে।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল তার নিজের ফেসবুকে নিজ উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের ছবি পোস্ট করেন। মুহূর্তেই পোস্টের নিচে ছাতক ও পার্শ্ববর্তী দোয়ারাবাজার উপজেলার কমপক্ষে ২০টি এলাকার লোকজন জানান, তাদের এলাকায় সাহায্য পৌঁছায়নি।

এই ছাত্রলীগ নেতা পরের এক পোস্টে সুনামগঞ্জে ত্রাণের সংকটের কথা লিখে জানান, তাদের প্রয়োজনীয় নৌকা আছে।

'বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও'- হাওর এলাকায় এ কথাটি বহুল প্রচলিত সত্য। এখন যখন বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে, কয়দিন পর নদী-খাল তীরবর্তী এলাকা বাদে অন্য কোথাও হাঁটা ছাড়া পৌঁছানোর কোনো উপায় থাকবে না।

সিলেটের প্রত্যন্ত হাওড়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে পানিবন্দি মানুষজনের মধ্যে খাবার-পানির জন্য যে মরিয়াভাব দেখা গেছে, তাতে মনে হয়েছে সামনের দিনে এই মানুষগুলো হিংস্র হয়ে উঠবেন।

অন্যদিকে, বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ফেলা ত্রাণ নিতে গিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা স্টেডিয়ামে গতকাল বিকেলে ১০ জন আহত হয়েছেন। এদের একজন আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মারা গেছেন বলে স্থানীয় সাংবাদিক কামাল আহমেদ জানিয়েছেন।

সব মিলিয়ে এখনই সরকারি-বেসরকারি সব বন্যা পরবর্তী তৎপরতা প্রশাসনের নেতৃত্বে সমন্বয়ের আওতায় আনা জরুরি। নতুবা বিশৃঙ্খলা মানুষের ভোগান্তি চরমে নিয়ে যাবে।

সরকারের একটি ঘোষণাই এই অবস্থার অবসান ঘটাতে পারে। এখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সিলেটসহ অন্যান্য বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের জন্য স্থানীয় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি সমন্বয় সেল গঠন করতে পারে। এই সেল সরকারি-বেসরকারি সকল উদ্যোগের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করবে। বেসরকারি উদ্যোগে যারাই ত্রাণ দিতে যাবে, এই সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাবে। সেল তালিকা অনুযায়ী বলে দেবে বা নির্দিষ্ট এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে।

যেকোনো দুর্যোগে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে। স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতার কোনো সুযোগ না থাকায় জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সমূহ সম্ভাবনা আছে। এটাতেও মনোযোগ দিতে হবে।

কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীলরা কি আদৌ সেসব ভাবছেন?

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

5h ago