বন্যা: সবচেয়ে দুর্দশায় দুর্গম এলাকার মানুষ

সিলেটের জৈন্তাপুরের চাটলারপুরের বাসিন্দা আয়তুন বন্যার ৯ দিন পর ত্রাণ পেয়েছেন। ছবি: পলাশ খান/স্টার

সিলেট বিভাগের ৩৩৬ ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বাসিন্দারা চরম দুর্দশায় আছেন। এই ৯৩টি ইউনিয়নের হাজারো মানুষ এখনো কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা পাননি বললেই চলে।

আরও ৬৭টি ইউনিয়নের মানুষও যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ না পেয়ে দুর্দশায় আছেন।

প্রায় প্রতিটি জায়গায় প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ঠিকমতো এগোচ্ছে না। ব্যক্তি পর্যায়ের ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোরও একই অবস্থা। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারাই ঠিকমতো ত্রাণ পাচ্ছেন না।

তৃণমূল পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বন্যা আঘাত হানার পর বেশ কয়েকদিন চলে গেলেও এখনো সেসব জায়গায় প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি।

ত্রাণের আশায় ভিড় করে আছেন জৈন্তাপুরের দরবস্ত ইউনিয়নের গার্ধনা গ্রামের বাসিন্দারা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

এখনো যেসব বন্যাদুর্গত এলাকায় কোনো ধরনের ত্রাণ পৌঁছেনি, তার মধ্যে আছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের যথাক্রমে ৩৬, ৩৮, ৮ ও ১১টি ইউনিয়ন।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, ইতোমধ্যে এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে আসা ত্রাণ পেয়েছেন সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণার ২৪টি উপজেলার ৫৭ হাজার ৮৬০ বাড়ির মানুষ।

ত্রাণ এখনো দুর্লভ

জৈন্তাপুর ইউনিয়নের চাতলারপুর গ্রামের বাসিন্দা আয়তুন গত ৯ দিন শুধু চিড়া খেয়ে বেঁচে আছেন। এই ইউনিয়নে বুক-সমান পানি উঠেছে প্রায় ১০ দিন আগে।

আয়তুন বলেন, 'শুরুতে আমাদের কাছে কিছু খাবার ছিল। কিন্তু গত ৯ দিন খুব কষ্টে গেছে। আমরা একবেলাও ঠিকমতো খেতে পারিনি।'

বন্যার পানিতে তার সব সহায়সম্পত্তি ভেসে গেছে।

ত্রাণের আশায় নৌকায় করে এসেছেন এক নারী। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'আমি আগে দিনমজুরের কাজ করতাম। বন্যার পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত আমার কোনো রোজগারের সম্ভাবনা নেই', যোগ করেন তিনি।

একটি ত্রাণবাহী নৌকা তার বাসার কাছে এলে তিনি সেখান থেকে এক ব্যাগ ত্রাণ সংগ্রহ করেন। তবে তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেন, ব্যাগটিতে শুধু এক বোতল মিনারেল পানি ও কিছু পরিমাণ চিড়া রয়েছে।

দরবস্ত ইউনিয়নের পশ্চিম গর্ধনা গ্রামের অনেক মানুষ ত্রাণবাহী নৌকার কাছে পৌঁছানোর জন্য নিজ নিজ ডিঙ্গি নৌকা ব্যবহার করেন। যাদের এ ধরনের কোনো পরিবহন নেই, তারা বুক-সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে ত্রাণবাহী নৌকার আরোহীদের ডাকতে থাকেন।

এটাই ছিল সেখানে পৌঁছানো প্রথম ত্রাণবাহী নৌকা।

ডিঙ্গিতে অপেক্ষমাণ ফরিদুন বলেন, 'আমার ৬ সদস্যের পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য মাত্র ২ দিনের চাল আছে।'

'শেষবার এটুকু চালই আমি কিনতে পেরেছিলাম। আমরা বিছানার ওপর চুলা বসিয়েছি এবং এ কারণেই এখনো রান্না করতে পারছি', যোগ করেন তিনি।

ইতোমধ্যে নেত্রকোণার বাসিন্দারাও ত্রাণের অভাবে দুর্দশায় আছেন।

১০টি উপজেলার মধ্যে কমলাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টা, মহানগঞ্জ ও খালিয়াজুরির মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় আছে।

গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে খালিয়াজুরির বাসিন্দা রনি জানান, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা উপযোগিতার সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের সমন্বয় করছেন।

ত্রাণের আশায় ভিড় করে আছেন জৈন্তাপুরের দরবস্ত ইউনিয়নের গার্ধনা গ্রামের বাসিন্দারা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

স্থানীয় সাংবাদিক রাজিব সরকার গত ৬ দিনে বিভিন্ন বন্যাদুর্গত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ মানুষ অভুক্ত আছে। স্থানীয় প্রশাসন শুধুমাত্র কাছের এলাকাগুলোতে পৌঁছাতে পেরেছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।'

প্রশাসনিক সমস্যা

ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ জানান, তারা ১ হাজার ১০০ পরিবারের জন্য ত্রাণ হিসেবে ২৪ বস্তা চাল পেয়েছেন, যার অর্থ প্রতিটি পরিবারের জন্য মাত্র ১ দিনের খাবার পাওয়া গেছে।

বেশ কয়েকজন স্থানীয় কাউন্সিল প্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক নিশ্চিত করেন, তারা যাতায়াত সমস্যা ও ত্রাণ সংকটের কারণে অসংখ্য বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও এসব সমস্যার সত্যতা মেনে নেন।

সিলেটের বিশ্বনাথের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোজিনা আক্তার বলেন, 'এই উপজেলায় নৌকা খুবই দুর্লভ। যেসব সড়কে বন্যার পানি ওঠেনি, সেগুলো যাত্রাপথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও, এই উপজেলায় খুব বেশি বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।'

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও মধ্যনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসীর হাসান বলেন, 'হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলোতে যাওয়া খুবই ঝামেলার। যাতায়াতের সমস্যার কারণে সেসব দুর্গম এলাকার বন্যাদুর্গতদের কাছে খুব বেশি ত্রাণ পৌঁছায়নি।'

সিলেটের জৈন্তাপুরের চাটলারপুরের বাসিন্দা আয়তুন বন্যার ৯ দিন পর ত্রাণ পেয়েছেন। ছবি: পলাশ খান/স্টার

মৃতের সংখ্যা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৪ জনের মৃত্যুতে বন্যায় মোট মৃতের সংখ্যা এখন ৬৮।

তাদের মাঝে শুধু সিলেট বিভাগেই মারা গেছেন ২৩ জন। প্রতিবেদন মতে, ২০ ব্যক্তি বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছেন।

১৭ মে থেকে ২৩ জুনের মধ্যে এই ৬৮ জন মারা গেছেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

The wrongs of past 15yrs must be righted

The Daily Star spoke to BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir on a host of issues ranging from elections to media freedom 

15h ago