অর্থ সংকটে বন্ধের পথে দিনাজপুর বধির ইনস্টিটিউট
দিনাজপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর বধির ইনস্টিটিউট। গত ৩২ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কাজ করছে। বর্তমানে অর্থ সংকটে প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৯০ সালে দিনাজপুর শহরের গুঞ্জাবাডী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও কর্মচারীরা ১৮ বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েই এটি সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে থেকে নিবন্ধন লাভ করে। প্রথমে একটি অস্থায়ী টিন চালা ঘরে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়।
তৎকালীন স্থানীয় সামাজিক উদ্যোক্তা ও দিনাজপুর পৌরসভার তৎকালীন সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আমিনুল হক ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। দিনাজপুরের আরও ২ সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী বদিউল আলম পাটোয়ারী ও আবুল হোসেন পাটোয়ারী এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
প্রতিষ্ঠার পর, ইনস্টিটিউটটি বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যাপক সাড়া পায়। এক দশকের মধ্যে এটি বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিভাবকদের কাছে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সেক্রেটারি আজহারুল আজাদ জুয়েল বলেন, জেলার প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়াই ছিল প্রতিষ্ঠানের একমাত্র লক্ষ্য। রংপুর বিভাগে এমন শিশুদের জন্য এটিই এখন একমাত্র আবাসিক প্রতিষ্ঠান।
প্রাথমিকভাবে, অনেক শিক্ষক এবং কর্মচারী স্বেচ্ছায় তাদের সেবা প্রদান করেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকদের দক্ষতা ও মান উন্নয়নের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকা এবং চাহিদামত বেতনভাতা না থাকায় অনেক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
প্রতিষ্ঠানটির মান উন্নয়নে দিনাজপুর সদর আসনের তৎকালীন এমপি এম আব্দুর রহিম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদার প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়।
তৈয়বা মজুমদার প্রতিষ্ঠানটির জন্য জমি সংগ্রহ ও ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। প্রতিষ্ঠানের পাশে থাকা দিনাজপুর জুবিলী বিদ্যালয় দিনাজপুর বধির ইউস্টিটিউটকে ৪০ শতক জমি দান করে। যেটা তৈয়বা মজুমদার ব্যবস্থা করে দেন। পরে সেখানে সরকারি তহবিল থেকে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০০৬ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং ৬ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভবনটি উদ্বোধন করলে শুরু হয় নতুন ভাবে শিক্ষাকার্যক্রম। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন চালু করারও আশ্বাস পাওয়া যায়। এই ভবনটিতে ৫০ জন শিক্ষার্থীর আবাসিক ব্যবস্থা আছে।
একই বছর, প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ চূড়ান্ত করার পর প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাগত ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ পুরো গতিতে শুরু হয়।
প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষকরা জানান ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি করণে আশ্বাস পাওয়া যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুরা বাস করছে। সংস্কারের অভাবে ভবনের প্লাস্টার ধসে পড়ছে।
ভবনটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলা হলো আবাসিক ছেলে-মেয়েদের থাকার জায়গা। অন্যদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় তলা একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষিকা নাজনীন আক্তার জানান, গত ১৮ বছর ধরে তিনি সেখানে মাসিক বেতন ছাড়াই কাজ করছেন। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মচারীরাও বেতন না পেয়েও সেখানে কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত ৩ জন শিক্ষক চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
গত বছর এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১১০ জন। এর মধ্যে দিনাজপুর ও আশেপাশের জেলা বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও ও রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থী ছিল।
তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব ভ্যানে করে শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়া করতো। কিন্তু ভ্যান চালকদের বেতন না দেওয়ায় ও অর্থাভাবে ভ্যানগুলো মেরামত না করতে পারায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয় ভ্যান সেবা। ফলে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানে আসা বন্ধ করে দেয়।
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৫০ জন আবাসিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৩ জন ছাত্রী।
প্রধান শিক্ষিকা বলেন, তাদের খাবার এবং আবাসিক সহায়তা প্রদান করাও একটি বড় কাজ। স্থানীয় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর আবাসিক শিক্ষার্থীদের কিছু সহায়তা প্রদান করে। শিক্ষার্থীদের বাকী খাবার ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ২০১২ এবং ২০১৫ সাল থেকে যথাক্রমে ৬৪ এবং ৩৪ জন শিক্ষার্থী তাদের পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ সফল ভাবে পাশ করেছে। শিক্ষকের অভাবে বিভিন্ন কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণও বন্ধ রয়েছে।
ইনস্টিটিউটের একজন কর্মী রাবেয়া বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি ১৯৯০ সালে ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। ২০২২ সালে তার বেতন ২ হাজার টাকা। এই টাকায় তার চলা সম্ভব নয়। আবাসিক শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব তার হওয়ায় তিনি এখানে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন।
আরজিনা খাতুন বলেন, আমি ছেলে আহসাব জামানকে ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করাই। আমার ছেলের উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করেছি। সে এখন ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র।
সরকারি তহবিল থেকে সহায়তার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'শিক্ষক কর্মচারীরা যদি বেতন না পান তা হলে তারা চলবেন কীভাবে।'
যোগাযোগ করা হলে দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও দিনাজপুর বাধির ইনস্টিটিউটের সভাপতি দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, তিনি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছেন।
Comments