এই নব ফাল্গুনের দিনে, কে তোমারে নেবে চিনে
উত্তুরে হাওয়া বিদায় করে দেওয়া দখিনা বাতাসের ঝাপটায় চারদিকে দোল দোল ভাব। কমলা রোদের রঙ একটু অন্যরকম। পাতা ঝরার দিন শেষে ডালে ডালে নতুন কুঁড়িদের উদ্ভাস। প্রকৃতিতে রঙিন শাসনের অভিষেকে প্রাণে প্রাণে খুশির হিল্লোল।
আজ বুধবার পয়লা ফাল্গুন। যৌবনের রাজদণ্ড যে ঋতুর হাতে, সেই বসন্তের প্রথম দিন; নবীন আনন্দে জেগে ওঠার উদ্বোধনের কাল।
এমনিতেই বসন্তের প্রথম দিনটি পরিচিত 'বাঙালির ভালোবাসার দিন' হিসেবে। কয়েক বছর আগেও পয়লা ফাল্গুন ও পশ্চিমা রীতির ভ্যালেন্টাইন ডে পরপর দুটি দিনে উদযাপন করা হতো। তবে নতুন করে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কারণে ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে একই দিনে উদযাপিত হচ্ছে দিবস দুটি।
সেই ধারাবাহিকতায় এবারও বসন্ত আর ভালোবাসা দিবস এসেছে জোড় বেঁধে। পাশাপাশি বিদ্যা ছাড়াও বিদ্যার্থীদের জীবনে-মননে প্রেম-রাগিনীর প্রথম উন্মেষে যার ভূমিকাকে মূখ্য ধরা হয়, সেই বীণাপাণি দেবী সরস্বতীর পূজাও এবার পড়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি।
সুতরাং ভালোবেসে মনের মন্দিরে প্রিয়জনের নাম লেখার দিন তো আজই। কেবল পথে বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা। এরপর কে কাকে চিনে নেবে, সেটা না হয় সময়ের হাতেই তোলা থাক।
বসন্তকে বলা হয় যৌবনের দূত; নবজীবনের প্রতীক। ঋতুরাজ হিসেবে এর খ্যাতি সেই আবহমানকাল থেকেই। শীতে রুক্ষ হয়ে ওঠা মৃতপ্রায় প্রকৃতিকে কোমল করে তোলে বসন্ত, যার প্রভাব পড়ে মানুষের হৃদয়ে। চিত্ত আকুল হয় প্রিয় কারও সান্নিধ্য পেতে। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন, 'সে কি আমার কুঁড়ির কানে কবে কথা গানে গানে/পরান তাহার নেবে কিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে-'।
বসন্তের উদ্বোধনে এখন গ্রাম তো বটেই, রাজধানীর উদ্যান এলাকায় কান পাতলেও শোনা যাবে কোকিলের কুহু ডাক কিংবা মৌমাছির গুঞ্জরণ। শহরের ফুলের দোকানসহ বিপণিবিতানগুলোতেও সাজ সাজ রব।
আজ নানা বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা বরণ করে নিচ্ছে ঋতুরাজকে। তরুণ-তরুণীরা নিজেকে রাঙিয়েছেন হলুদ, কমলা, বাসন্তী রঙের পোশাকে। প্রিয়াকে 'হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল' কোনো তরুণ হয়তো বেছে নেবেন আজকের দিনটিকেই।
ইতিহাস বলছে, ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের সঙ্গে প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব।
১৯০৭ সালে কবিগুরুর ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যাত্রা শুরু হয় বসন্ত উৎসবের, যা 'ঋতুরঙ্গ উৎসব' নামেই পরিচিত।
আর স্বাধীন বাংলাদেশে এর গোড়াপত্তন ঘটে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছোট্ট পরিসরে শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
পরে ১৪০১ বঙ্গাব্দে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ- এর আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় বসন্ত উৎসব পালন শুরু হয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক দিবসগুলোকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তন করা হয়েছিল খ্রিস্টীয় ২০১৯ সাল অর্থাৎ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে। তাতে ১৯৫২ সালের মতো ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুনে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পয়লা পৌষেই সমন্বয় করা গেলেও পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস হয়ে যায় একদিনে।
আবার প্রেমের পাশাপাশি বসন্ত ঘিরে বাঙালিদের দ্রোহ-প্রতিবাদের ইতিহাসও আছে। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে বাংলার তরুণেরা এই ফাল্গুনেই রক্ত ঝরিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারী এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা জাফর-জয়নাল-দীপালি-কাঞ্চনদের বুকের রক্তে ভেসেছিল ঢাকার রাজপথ। কালক্রমে যে আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ভালোবাসা দিবসের আড়ালে অনেকটা ঢাকা পড়ে যাওয়া এই দিনটি অনেকের কাছে পরিচিতি 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে।
Comments