৩ বছরে ডিএসএলআরের বাজার দখল করতে পারে স্মার্টফোন
স্মার্টফোনের বাজার সম্পর্কে সম্প্রতি কিছু আকর্ষণীয় এবং দূরদর্শী বিবৃতি দিয়েছে প্রযুক্তিপণ্য নিমার্ণকারী প্রতিষ্ঠান সনি। তাদের ধারণা স্মার্টফোনগুলো আগামী ৩ বছরের মধ্যে ডিএসএলআরের বাজার দখল করে নেবে।
সনির মতে, ফোনের ক্যামেরাগুলো দিন দিন আরও উন্নত হতে থাকবে এবং আগামী ৩ বছরের মধ্যে স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ডিএসএলআরের চেয়ে ভালো ছবি তোলা যাবে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ডিএসএলআরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে স্মার্টফোনের ক্যামেরা। সনির মতে, ২০২৪ সালের দিকে স্মার্টফোন থেকে পাওয়া ছবির গুণগতমান তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ডিজিটাল সিঙ্গেল-লেন্স-রিফ্লেক্স (ডিএসএলআর) ক্যামেরাকে ছাড়িয়ে যাবে।
জাপানের গণমাধ্যম নিক্কেই-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, সনি সেমিকন্ডাক্টর সলিউশনস (এসএসএস)-এর প্রেসিডেন্ট এবং সিইও তেরুশি শিমিজু এক ব্রিফিংয়ে বলেন, 'আমরা আশা করি স্মার্টফোন থেকে পাওয়া স্টিল পিকচারগুলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ডিএসএলআর ক্যামেরার ছবির মানকে অতিক্রম করবে।'
এ বিষয়ে সনি এক ব্রিফিংয়ে কিছু স্লাইড উপস্থাপনের মাধ্যমে বিষয়টি আরও খুঁটিনাটিভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
সেখানে বলা হয়, স্মার্টফোনের প্রযুক্তি তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি। তাই স্মার্টফোনগুলো তাদের ছবির বিবর্তনকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
ফোন ক্যামেরার এই উত্থান কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব হবে?
সিইও তেরুশি শিমিজু এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। তবে নিক্কেই-এর প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সনি 'কোয়ান্টাম স্যাচুরেশন' এবং 'এআই প্রসেসিং'-এর উন্নতিসহ কয়েকটি বিষয়ের দিকে জোর দিচ্ছে। সনি আশা করছে, ২০২৪ সালের মধ্যে 'হাই-এন্ড মডেল' ফোনগুলোতে সেন্সরের আকার দ্বিগুণ হবে।
এজন্য ভবিষ্যতে যা করা হবে তা হচ্ছে, পিক্সেলের ব্যাস বৃদ্ধি। পাশাপাশি নতুন পিক্সেল কাঠামো বা 'টু-লেয়ার ট্রানজিস্টর পিক্সেল' প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির সমন্বয়। যা বেশি আলোতে ছবি তোলার কার্যক্ষমতাকে দ্বিগুণ করে তুলবে।
এই সেন্সরগুলোর বড় পিক্সেল, ফোন নির্মাতাদের মাল্টি-ফ্রেম প্রসেসিং প্রয়োগের সুযোগ দেবে। এর সঙ্গে আরও থাকবে উন্নত সুপার এইচডিআর মোড এবং সনি এক্সপেরিয়া ১ আইভির মতো এআই অ্যালগরিদম। যে এআই অ্যালগরিদমটি ভাঁজ করা অপটিক্সকে একত্রিত করে জুম করতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে সনি যে টু-লেয়ার ট্রানজিস্টর পিক্সেল প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা তুলে ধরেছে। সেটি ফোন ক্যামেরার ডাইনামিক রেঞ্জকে ব্যাপকভাবে উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে এটি কম-আলোয় নয়েজ কমাতেও সাহায্য করবে।
সনির উপস্থাপনা অনুসারে, ভিডিওর জন্য একই ধরনের অগ্রগতি আসছে। উচ্চতর রিড-আউট গতিসহ ৮-কে ভিডিও, ভিডিও এইচডিআরসহ মাল্টি-ফ্রেম প্রসেসিং এবং 'ভিডিওর জন্য এআই প্রসেসিং'-এর মতো ফিচারের উন্নতির দিকটিও তারা তুলে ধরেছে।
এ ছাড়া এইট-কে ভিডিও শুট বা হাই-স্পিড রিডআউটের সময় টিওএফ বা দূরত্ব পরিমাপ সেন্সর ব্যবহার করে ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লারিংও ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।
যদিও সনির পক্ষে এ বিষয়ে জোরালো ভবিষ্যদ্বাণী করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ তারা এই খাতে ইতোমধ্যেই প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ডিএসএলআর এবং মিররলেস ক্যামেরার বিপরীতে ফোন ক্যামেরাগুলোর ক্রমাগত বিবর্তনের জের ধরে সনির ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর পেছনে তাই যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।
আর এটি প্রায় সব স্মার্টফোনের জন্যেই প্রযোজ্য। পরিসংখ্যান বিষয়ক সংস্থা স্ট্যাটিস্টা-এর মতে, বিশ্বব্যাপী ফোনের ইমেজ সেন্সরের বাজারে প্রায় ৪২ শতাংশই সরবরাহ করে সনি। এমনকি আইফোন ১৩ প্রো ম্যাক্স-এর ক্যামেরা ৩টিও সনি আইএমএক্স ৭-সিরিজের সেন্সর ব্যবহার করে।
স্মার্টফোনের ক্রমাগত উন্নতির বিশ্লেষণ
ডিএসএলআর ক্যামেরার মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী কোনো নতুন বিষয় নয়। স্পষ্টভাবে কিছু না জানিয়েই ক্যানন এবং নিকন উভয়ই স্বীকার করেছে যে ডিএসএলআর এখন শুধু একটি লেগ্যাসি ফর্ম্যাট৷ যেগুলো তারা প্রতিস্থাপন না করে বন্ধ করে দিচ্ছে। যেমন, নিকন ডি৩৫০০ সেই বন্ধ করা মডেলগুলোর একটি।
অন্যদিকে সনির সাম্প্রতিক বিবৃতিতে যে বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো, ফোনের ক্যামেরাগুলো তাদের প্রযুক্তির চূড়ায় পৌঁছানোর আগে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। অর্থাৎ ফোনের ক্যামেরার উন্নতি অব্যাহত থাকবে।
এ ক্ষেত্রে ফোনের ক্যামেরায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি এসেছে মাল্টি-ফ্রেম প্রক্রিয়াকরণে। যা কম্পিউটেশনাল ফটোগ্রাফি নামেও পরিচিত। তবে ফোন ক্যামেরাকে নতুন উচ্চতার ফটোগ্রাফিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন নতুন হার্ডওয়্যারের উন্নতির দিকে সনি বেশি জোর দিয়েছে।
২০২৪ সালের দিকে হাই-এন্ড ফোনগুলোয় সেন্সরের আকার দ্বিগুণ হবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী কিছুটা আশ্চর্যজনক। কারণ বিষয়টি বিভিন্ন কারণে সীমাবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লেন্সের বিষয়টি।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে সনি এক্সপেরিয়া প্রো-আই সনির প্রথম ১-ইঞ্চি সেন্সরযুক্ত ফোন। তবে ফোনটির লেন্স সেই সেন্সরটি পুরোপুরিভাবে কভার করার জন্য যথেষ্ট বড় ইমেজ সার্কেল প্রসারণে সক্ষম হয়নি। যার কারণে এটি কেবল ১২ মেগাপিক্সেল ফটো গ্রহণ করতে পারতো। অথচ যা ২০ মেগাপিক্সেল রেজোলিউশনের হওয়ার কথা ছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সনির নতুন ২-স্তর ট্রানজিস্টর পিক্সেল বিশিষ্ঠ স্ট্যাকড সিএমওএস সেন্সরটি। যা প্রতিটি পিক্সেলকে একটি সাধারণ সেন্সরের তুলনায় দ্বিগুণ আলোতে কার্যকরভাবে তুলে ধরতে সক্ষম। এই হার্ডওয়্যারের অগ্রগতি কম্পিউটেশনাল অ্যালগরিদমগুলিকে আরও ডাইনামিক পরিসরের এবং নয়েজ সম্পর্কিত কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ফোনগুলোতে ফটোগ্রাফির উন্নতি বিবেচনা করলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় তা হচ্ছে ভিডিওর ক্ষেত্রে। সম্ভবত আগামী কয়েক বছরে আমরা খালি চোখে যে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি দেখতে পারব তা হচ্ছে ভিডিওর ক্ষেত্রে। সনির প্রেজেন্টেশনে ভিডিওর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ফোনে অগমেন্টেড রিয়েলিটি অ্যাপ আরও ভালোভাবে সাপোর্টের বিষয়টি সম্পর্কেও আলোচনা করে। যা তারা মাল্টি-ফ্রেম প্রসেসিং এবং এর এজ এআই প্ল্যাটফর্মের উন্নতির মাধ্যমে অর্জন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যদিও ডিএসএলআর এবং মিররলেস ক্যামেরা তাদের হ্যান্ডলিং, ক্রিয়েটিভ মুভমেন্ট, ভিউফাইন্ডার এবং সিঙ্গেল-শট ছবির গুণমানের কারণে অনেক শখের কিংবা পেশাদার ক্রেতাদের মাঝে টিকে থাকবে। তবে সনির উপস্থাপনায় স্মার্টফোনের অগ্রগতি সম্পর্কিত বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, আগামী কয়েক বছর বিশেষভাবে ফোন ক্যামেরার জন্য বেশ উত্তেজনাপূর্ণ সময় হতে চলেছে।
তথ্যসূত্র: নিক্কেই জাপান, টেক র্যাডার, ফটো রুমোর্স
Comments