ফখরের তাণ্ডবে সেমির আশা বাঁচিয়ে রাখল পাকিস্তান
ম্যাচের মাঝপথের চিত্র বলছিল, পাকিস্তানের বিদায় ঘণ্টা বেজে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। তা হবে না-ই বা কেন! তাদের সামনে ৪০২ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য তাড়ার ভীষণ কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল নিউজিল্যান্ড। কিন্তু ঘাবড়ে গেল না দলটি। ওপেনার ফখর জামান বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে খেললেন স্মরণীয় এক ইনিংস। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিলেন অধিনায়ক বাবর আজম। এরপর দুই দফা হানা দিয়ে বৃষ্টিও দিল সহায়তার হাত বাড়িয়ে। এতে কিউইদের বিপক্ষে দুর্দান্ত জয় তুলে নিল পাকরা।
শনিবার বেঙ্গালুরুতে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ডিএলএস পদ্ধতিতে ২১ রানে জিতেছে পাকিস্তান। টস হেরে আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৪০১ রানের পুঁজি পায় নিউজিল্যান্ড। জবাবে পাকিস্তান ২৫.৩ ওভারে ১ উইকেটে ২০০ রান করার পর বৃষ্টির বাগড়ায় বন্ধ হয়ে যাওয়া খেলা আর চালানো সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে খেলার ইতি টেনে পাকিস্তানকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। ডিএলএস পদ্ধতি অনুসারে, ২৫.৩ ওভারে ১৭৯ রান ছিল পার স্কোর। ২০০ রান তোলা পাকিস্তান তাই ২১ রানে এগিয়ে থাকার সুবাদে শেষ হাসি হেসেছে।
এই জয়ে ২০২৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার আশা বেঁচে থাকল বাবরদের। আট ম্যাচে চতুর্থ জয়ে ৮ পয়েন্ট নিয়ে তারা উঠেছে পয়েন্ট তালিকার পঞ্চম স্থানে। সমান ম্যাচে সমান পয়েন্ট নিয়ে নেট রান রেটের হিসাবে তাদের ঠিক উপরেই অবস্থান করছে নিউজিল্যান্ড। চার নম্বরে থাকা দলটির এটি অবশ্য টানা চতুর্থ হার। ৮ পয়েন্ট রয়েছে ছয়ে নেমে যাওয়া আফগানিস্তানেরও। তারা অবশ্য একটি ম্যাচ কম খেলেছে।
চাপের মুখে পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার নজির কম নয়। এদিনও সেরকম আভাসই পাওয়া গিয়েছিল তাদের ব্যাটিংয়ের শুরুতে। দ্বিতীয় ওভারেই টিম সাউদির শিকার হয়ে বিদায় নেন আব্দুল্লাহ শফিক। পেছনের দিকে ঘুরে দৌড়ে অসাধারণ এক ক্যাচ নেন কেইন উইলিয়ামসন।
এরপর আর কোনো উল্লাসের মুহূর্ত উপভোগের সুযোগ নিউজিল্যান্ডকে দেয়নি পাকিস্তান। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ফখরই দেননি। একের পর সীমানার বাইরে বল আছড়ে ফেলতে থাকেন। চারের চেয়ে ছয় হাঁকাতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন! পেসার ট্রেন্ট বোল্ট থেকে শুরু করে স্পিনার ইশ সোধি-গ্লেন ফিলিপস কেউই পাত্তা পাননি। ৩৯ বলে ফিফটি ছোঁয়ার পর বাঁহাতি ফখর সেঞ্চুরিতে পৌঁছান ৬৩ বলে। তখনও ইনিংসের ২০ ওভার পূর্ণ হয়নি।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন ফখর। অন্যপ্রান্তে বাবর দেখান দৃঢ়তা। সঙ্গী খুনে মেজাজে থাকায় তিনি বাড়তি কোনো ঝুঁকি নেননি। তবে চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে রানের চাকা সচলই রাখেন বাবর। নিয়মিত বাউন্ডারি আনতে থাকেন সময়ের অন্যতম সেরা এই ব্যাটার।
বৃষ্টির কারণে ম্যাচের ইতি ঘটার আগে ফখর অপরাজিত থাকেন ১২৬ রানে। ৮১ বলের বিস্ফোরক ইনিংসে তিনি মারেন ৮ চার ও ১১ ছক্কা। বিশ্বমঞ্চে এক ইনিংসে পাকিস্তানের হয়ে এতগুলো ছক্কা মারতে পারেননি আর কেউ। অর্থাৎ এটিও রেকর্ড। বাবর ৬ চার ও ২ চারের সাহায্যে ৬৩ বলে করেন হার না মানা ৬৬ রান। তাদের অবিচ্ছিন্ন দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে আসে ১৪১ বলে ১৯৪ রান।
মাঝেও একবার হানা দিয়েছিল বৃষ্টি। তখন ২১.৩ ওভারে পাকিস্তানের সংগ্রহ ছিল ১ উইকেটে ১৬০ রান। এরপর মাঠ উপযোগী করে খেলা চালু হলে তাদের নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪২ ওভারে ৩৪২ রান। কিন্তু মাত্র ৪ ওভার হওয়ার পরই আরেক দফার বৃষ্টিতে শেষ হয়ে যায় ম্যাচ।
ব্যাটিং স্বর্গে আগে ফিল্ডিং বেছে নিয়েছিল পাকিস্তান। আর আগে ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে তা দারুণভাবে কাজে লাগায় কিউইরা। ডেভন কনওয়ের সঙ্গে দারুণ ছন্দে থাকা রাচিন রবীন্দ্রর ওপেনিং জুটিতে আসে ৬৮ রান। কনওয়েকে ফিরিয়ে এ জুটি ভাঙেন হাসান আলী। তার শর্ট বলে পুল করতে গেলে গ্লাভসে লেগে চলে যায় উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ রিজওয়ানের হাতে। ৩৯ বলে ৩৫ রান করেন কনওয়ে।
এরপর অধিনায়ক উইলিয়ামসনকে নিয়ে দলের হাল ধরেন রাচিন। অসাধারণ ব্যাটিংয়ে ১৮০ রানের দুর্দান্ত এক জুটি গড়ে হতাশা বাড়াতে থাকেন পাকিস্তানের। তাতে বড় পুঁজির ভিত পেয়ে যায় দলটি। এরপর সেই ভিতে ইমারত গড়েন বাকি ব্যাটাররা। ১৪২ বল স্থায়ী এ জুটি গড়ার পথে বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেন রাচিন। এক আসরে নিউজিল্যান্ডের হয়ে তিনটি সেঞ্চুরি এর আগে করতে পারেননি কেউই।
দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি ককের পর এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে পাঁচশ রানের মাইলফলকও স্পর্শ করেন রাচিন। আট ইনিংসে তার রান এখন ৫২৩। বিশ্বকাপে অভিষেক আসরে তার চেয়ে বেশি রান আছে কেবল ইংল্যান্ডের জনি বেয়ারস্টোর। ২০১৯ বিশ্বকাপে ১১ ইনিংসে দুটি করে ফিফটি-সেঞ্চুরিতে ৫৩২ রান করেছিলেন তিনি।
সেঞ্চুরি পেতে পারতেন চোট কাটিয়ে একাদশে ফেরা উইলিয়ামসনও। ব্যক্তিগত ৯৫ রানে ইফতিখার আহমেদের বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে লং-অফে ধরা পড়েন ফখরের হাতে। ৭৯ বলে ১০ চার ও ২ ছক্কা মারেন তিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের শেষ চারটি ম্যাচেই পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করলেন উইলিয়ামসন। এই ইনিংস খেলার পথে বিশ্বকাপে হাজার রান পূর্ণ হয়ে যায় তার।
উইলিয়ামসনের বিদায়ের পর খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি রাচিন। মোহাম্মদ ওয়াসিমের বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে তিনি ক্যাচ দেন মিডউইকেটে। এর আগে ৯৪ বলে ১৫ চার ও ১ ছক্কায় ১০৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এরপর ড্যারিল মিচেল, মার্ক চ্যাপম্যান, ফিলিপস ও মিচেল স্যান্টনারের ক্যামিও। মিচেল ১৮ বলে ২৯, চ্যাপম্যান ২৭ বলে ৩৯, ফিলিপস ২৫ বলে ৪১ ও স্যান্টনার ১৭ বলে অপরাজিত ২৬ রান করেন।
পাকিস্তানের পক্ষে ৬০ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন ওয়াসিম। তবে বেজায় খরুচে ছিলেন বাকি পেসাররা। শাহিন শাহ আফ্রিদি ১০ ওভারে ৯০ রান দিয়ে থাকেন উইকেটশূন্য। বিশ্বকাপে পাকদের হয়ে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বোলিংয়ের বিব্রতকর রেকর্ড এখন তার। একটি করে উইকেট নিলেও হারিস রউফ ৮৫ ও হাসান আলী ৮২ রান দেন।
লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে আগামী ৯ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হবে নিউজিল্যান্ড। আর পাকিস্তানের শেষ ম্যাচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। দল দুটি আগামী ১১ নভেম্বর পরস্পরকে মোকাবিলা করবে।
Comments