কাতারের দোহা থেকে

মেক্সিকোর বিপক্ষে ‘যুদ্ধ’ জিততে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের ৭ কৌশল!

Argentina Fan

বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার আজ জিততেই হবে। ড্র হলেও লিওনেল মেসিদের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার ভাগ্য ঝুলে থাকবে অনেকগুলো 'যদি', 'কিন্তু'র উপর। এই 'যদি', 'কিন্তু' থেকে বাঁচার রাস্তা একটাই- আর্জেন্টিনার জয়! মেক্সিকোর বিপক্ষে বাঁচা-মরার এই ম্যাচ জিততে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি কি পরিকল্পনা সাজিয়েছেন সেটা জানার উপায় নেই। তবে কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে আসা আর্জেন্টাইন সমর্থকরা মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ম্যাচের জিততে  প্রায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে! যে যুদ্ধে কোনোভাবেই হারা যাবে না, হারলে যে ভেঙে যাবে ৩৬ বছর থেকে অপেক্ষায় থাকা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন!

Argentina Fan

আর্জেন্টিনা আর সৌদি আরবের ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামে কট্টর আর্জেন্টিনা সমর্থক টারা'র সঙ্গে পরিচয়। পুরো ম্যাচ জুড়ে সে মেসিদেরকে চিৎকার করে উৎসাহ দিয়ে গেছে। সেই ম্যাচে টারা'র সঙ্গে ঠিকমতো কথা না হলেও সৌদির কাছে হারার ম্যাচে তার অঝোর কান্না দেখে মোবাইল নাম্বারটা রেখে দিয়েছিলাম। পরে এক সময় সুযোগ বুঝে আড্ডা দেওয়া যাবে, এই ছিল ভাবনা। এমন ফুটবল পাগল সমর্থক তো আর সহজে পাওয়া যায় না।

ব্রাজিল আর সার্বিয়ার ম্যাচ শেষে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের বিজয়ের উৎসব দেখে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সকাল। তাই ঘুম থেকে দেরি করেই উঠেছি। ইংল্যান্ড আর যুক্তরাষ্ট্রের খেলা ছিল রাতে। কাল সারাদিন কোনো কাজ ছিল না। দুপুরের পর ফোন দিলাম টারাকে, জানতে চাইলাম ফ্রি আছে কিনা। বললো আর্জেন্টিনা-মেক্সিকো ম্যাচ নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমি বললাম, বিকেলে তার হাতে যদি সময় থাকে তাহলে দেখা করতে চাই। বিকেলে দেখা করতে পারবে না, কিন্তু রাতে সময় দিতে পারবে জানালো।

Argentina Fan

টারা আর্জেন্টিনার কর্ডোভা শহরের মেয়ে। পেশায় ট্যুর প্ল্যানার। এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বিশাল এক বাহিনীকে নিয়ে কাতারে এসেছে। বিশ্বকাপের এই ট্যুর থেকে তার যা লাভ হবে সবই খরচ হয়ে যাবে বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার সব ম্যাচের টিকেট তো করেছেই, একেবারে ফাইনাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ম্যাচের কন্ডিশনাল টিকেট করে বসে আছে। আরো অনেক আর্জেন্টাইন সমর্থকের মতো তারও দৃঢ় বিশ্বাস এই বিশ্বকাপ দিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা খরা কাটবে আর্জেন্টিনার!

Argentina Fan

ইংল্যান্ড আর যুক্তরাষ্ট্রের খেলা দেখতে গিয়েছিলাম খুব আশা নিয়ে। ক্লাব ফুটবলে আমি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেই ইংলিশ ফুটবল লিগকে। শিরোপার অনেক দাবিদার থাকায় ইংলিশ ফুটবল লিগের মতো এমন উত্তেজনাপূর্ণ ফুটবল লিগ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। এছাড়া ইংল্যান্ড দলে তারকার ছড়াছড়ি। ফুটবলের মৌসুমী দর্শকদের কাছে অচেনা হলেও, যারা মৌসুমী ফুটবল দর্শক না তাদের সবার কাছেই ইংল্যান্ডের ফুটবলাররা একেকজন বিশাল তারকা। তারুণ্যে ভরপুর এমন এক দল নিয়ে গ্যারেথ সাউথগেট এবার বিশ্বকাপে এসেছেন যারা শিরোপার দাবিদার এই বিশ্বাস অনেকেরই। কিন্তু প্রথম খেলায় গোলের বন্যা বইয়ে দেওয়া সেই ইংল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জালে একবারও বল ঢুকাতে পারেনি, আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণের খেলায় যুক্তরাষ্টও পারেনি ইংল্যান্ডকে কোনো গোল দিতে। গোলশূন্য এক খেলা দেখে বের হলাম স্টেডিয়াম থেকে। মাঠে শুধু ফাও হিসেবে পেলাম ইংল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত সমর্থক গোষ্ঠী বার্মি আর্মিদের গলা ফাটানো চিৎকার। এরপর ফোন দিলাম আর্জেন্টিনার মেয়ে টারাকে, সে আমাকে তার অবস্থান জানিয়ে সেখানে যেতে বললো।

Argentina Fan

দোহার অভিজাত এলাকা পার্ল কাতার। চোখ ধাঁধানো সব অট্টালিকা, দামি সব ব্র্যান্ডের দোকানে চারপাশ ভরপুর। সেখানেই এক ক্যাফেতে দেখা হলো টারা'র সঙ্গে। সে বসে আছে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বিশাল এক বাহিনী নিয়ে। যেহেতু টারা একজন ট্যুর প্ল্যানার, মানুষজন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায় তাই ইংরেজি খুব ভালো জানে। সেখানেই সে পরিচয় করিয়ে দিলো তার সাথে আর্জেন্টিনার বিভিন্ন শহর থেকে বিশ্বকাপ দেখতে আসা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের। যাদের বেশিরভাগ ইংরেজি বলতেই পারে না। তারা সবাই ছোট ছোট দলে আড্ডা দিচ্ছিলো স্প্যানিশে। তাই আমি টারাকে নিয়ে ক্যাফের একপাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, এত ব্যস্ততা কি নিয়ে? সে জানালো সারাদিন সে আর্জেন্টিনা যাতে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচ জিততে পারে সেই কৌশল নির্ধারণে পার করেছে! আমি বললাম, 'তুুমি তো টিম ম্যানেজম্যান্টের কেউ না, তুমি আবার কিসের কৌশল ঠিক করবে?'

আমার কথা শুনে টারা আমাকে বললো, 'মাঠে শুধু প্লেয়াররা খেললেই ম্যাচ জেতা যায় না। ম্যাচ জেতার জন্য সমর্থকদেরও অনেক কিছু করতে হয়।'

'সাপোর্টার স্ট্রাটেজি'- টারার কাছ থেকে আমি শিখলাম ফুটবলের এই নতুন টার্ম। মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচ জিততে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের স্ট্র্যাটেজি কি কি টারা'র কাছে জানতে চাইলাম। প্রথমে সে আমাকে বলতে চাইলো না। তারপর অনেক জোরাজুরির পর কোনো মেক্সিকানকে বলতে পারবো না এই শর্তে বলতে রাজি হলো। তারপর সে একে একে জানালো মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের কৌশলগত পরিকল্পনার কথা। সেগুলো হলো-

  •   আর্জেন্টাইন সমর্থকরা মাঠে চলে যাবে ম্যাচ শুরুর ৫ ঘণ্টা আগে।
  •   মেক্সিকানরা মাঠে ঢুকার আগে আর্জেন্টাইনরা মাঠে ঢুকে যাবে।  
  •   আসন নাম্বারের তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে পুরো গ্যালারিতে।
  •   মেক্সিকানদের দলবদ্ধ হয়ে বসার সুযোগ দিবে না। যাতে তারা গলা ফাটিয়ে কোরাসে মেক্সিকোকে উৎসাহ দিতে না পারে।
  •  বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে স্টেডিয়ামে যাবে, যাতে ম্যাচের পুরোটা সময়জুড়ে গানে আর চিৎকারে আর্জেন্টিনার প্লেয়ারদেরকে উৎসাহ দিতে পারে।
  •  মেসির উদ্দেশ্যে লেখা অনেকগুলো ব্যানার নিয়ে মাঠে যাবে। যাতে মেসি মাঠে তার সবটুকু উজাড় করে দিতে পারে।
  • মেক্সিকানরা যখন আক্রমণে যাবে তখন রেফারির বাঁশির মতো বাঁশি বাজিয়ে মেক্সিকান খেলোয়াড়দেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবাক হয়ে শুনলাম টারা'র সব কথা। তারপর টারাকে বললাম- মাঠের খেলা মাঠে রাখাই ভালো না। প্লেয়াররা খেলুক তাদের মতো, গ্যালারিতে তোমাদের এসব করার কি দরকার? টারা আমাকে বললো- 'দরকার আছে। যুদ্ধে নেমে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ খোলা থাকে না। হয় তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে, না হয় পরাজয় মেনে নিতে হবে। আর আমরা তো পরাজয় মেনে নিতে বিশ্বকাপে আসিনি। আর্জেন্টিনা প্রতিটি বিশ্বকাপে আসে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই!'

আর্জেন্টিনা যাতে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচটা জিতে টারাকে সেই শুভকামনা জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম। ফিরতি পথে আলো ঝলমলে পার্ল কাতারের রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট দলে হাঁটতে দেখলাম অনেক আর্জেন্টাইন সমর্থককে। তারাও হয়তো টারার মতো গ্যালারিতে বসে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে প্রিয় আর্জেন্টিনার জন্য...।

লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক। লেখার ব্যবহৃত ছবি লেখকের।     

Comments

The Daily Star  | English

Chief adviser returns home after joining COP29 in Baku

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus returned home this evening wrapping up his Baku tour to attend the global climate meet Conference of Parties-29 (COP29)

1h ago