কাতারের দোহা থেকে

আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এই গ্রহের সবচেয়ে আশাবাদী মানুষ!

Argentina Fan

পৃথিবীর সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী ব্যক্তি যদি আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কাছে আসেন তাহলে তিনিও হয়তো আশাবাদী হয়ে যাবেন। তার কারণ একটাই- আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মতো আশাবাদী মানুষ মনে হয় পৃথিবীতে আর নেই। এত আশাবাদীর কাছে আসলে তার আঁচ লাগা তো স্বাভাবিক। সৌদি আরবের সঙ্গে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে হারের পরও যেমন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, আর্জেন্টিনা কাতার থেকে বিশ্বকাপ নিয়েই বাড়ি ফিরবে!

ঢাকা থেকে দোহা এসেছি সোমবার। কাতারে আসার আগেই ঢাকা এয়ারপোর্টে দেখা পেয়েছি আর্জেন্টিনার বাংলাদেশি সমর্থকদের। আর্জেন্টিনার জার্সি পরে ঢাকা এয়ারপোর্ট আর বিমানের ভেতর গরম করে রেখেছিলেন সবাই। তাদের একজন ব্যবসায়ী সৈয়দ কামরুজ্জামান বসেছিলেন আমার পাশের সিটে। তার কাছে প্রথম প্রশ্নই ছিল- 'আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপে কতদূর যাবে?' আমার প্রশ্ন শুনে তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন মনে হলো পারলে আমাকে বিমান থেকে ফেলে দেন। প্রশ্নটা উনাকে দ্বিতীয়বার করতেই তিনি আমাকে বললেন, 'এটা মেসির শেষ বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপ মেসি ছাড়া অন্য কারো হাতে বেমানান।' আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে বলেই তিনি আর তার বন্ধুরা মিলে কাতারে যাচ্ছেন। তারপর তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন- 'আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার কিনা!' তার প্রশ্ন শুনে আমি একটু হাসতেই তিনি আমাকে বললেন, তিনি কোনো ব্রাজিলের সমর্থকদের সঙ্গে তর্ক করেন না।

তারপর তিনি ঘটিয়ে ফেললেন এক অদ্ভূত কাণ্ড। বিমানবালাকে ডেকে বললেন- আমার বসার সিট তার পাশে কিনা চেক করে দেখতে! বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন সমর্থকদের সঙ্গে কথায় পেরে উঠা সহজ নয়। তাই আমি কথা না বাড়িয়ে আমার কৌতূহলকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ঘুমিয়ে গেলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলাম- আর্জেন্টিনার সেই সমর্থক আর আমার পাশে নেই। সিট পাল্টিয়ে বসেছেন আমার থেকে তিন সিট পেছনে!

Argentina Fan

দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে নেমে ভেবেছিলাম চারদিকে দেখবো বিশ্বকাপে নানা দেশ থেকে আসা মানুষ। কিন্তু এয়ারপোর্ট দেখলাম একেবারে ফাঁকা, আমাদের ফ্লাইটের যাত্রী ছাড়া ইমিগ্রেশনে আর কেউই নেই। এয়ারপোর্টে অবশ্য বিশ্বকাপের নানা ধরনের ব্র্যান্ডিং আর সাজসজ্জায় বিশ্বকাপের একটা আমেজ আছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দেখা গেল এক নতুন দোহা। চারদিকে আলোকসজ্জা আর বিশ্বকাপে খেলতে আসা দেশগুলোর পতাকা টানানো। আর্জেন্টিনার আর কোনো সমর্থককে তখন দেখা যায়নি।

বিপুল সংখ্যক আর্জেন্টিনাইন সমর্থকদের দেখা পেলাম মঙ্গলবার সকালে। দোহা শহরে যেদিকেই গিয়েছি সেদিকেই আকাশী সাদা জার্সি পরে স্টেডিয়ামের দিকে ছুটছেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। পুরো দোহা শহর আকাশী সাদায় যেন কেউ মুড়িয়ে দিয়েছে অবস্থা এমন। অনেক ঝক্কি ঝামেলা আর নিরাপত্তার নানা মারপ্যাঁচ পেরিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকে যেদিকে চোখ গেছে সেদিকেই দেখি আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। পুরো গ্যালারিতে যেন এক টুকরো আকাশ নেমে এসেছিলো। যে আকাশ ম্যাচ শেষে হয়ে গিয়েছিল দুঃখে মেঘলা!

আমার পাশে বসেছিল ক্রিস্টিনা, যে এসেছে বুয়েনস আয়ার্স থেকে। ইংরেজি জ্ঞান 'ইয়েস', 'নট', 'থ্যাংকস', 'পারডন' এই পর্যন্ত। 'ওলা' এই শব্দটি ছাড়া আমিও স্প্যানিশ জানিনা। ইশারায় তার সঙ্গে কথা আগালাম, তার কথায় যতটুকু বুঝলাম- আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপ জিতবেই জিতবে! আর্জেন্টিনার সমর্থকরা পুরো ম্যাচে মাঠ গরম করে রাখলেন, গোলের পর স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে চিৎকার করলেন, রেফারির অফসাইডের বাঁশি শুনে একসাথে স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিন্তু সৌদি আরবের পর পর দুইটা অবিশ্বাস্য গোলে তারাও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না- তারা যে মেসির আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে এসেছেন। সময় যত নব্বই মিনিটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো ততই দুশ্চিন্তা আর্জেন্টিনার সমর্থকদের গলার আওয়াজকে কমিয়ে দিতো লাগলো। শেষদিকে যে আওয়াজকে একেবারে চুপ করিয়ে দিলো সৌদি আরবের গোলকিপারের অনবদ্য গোলকিপিং। ম্যাচ শেষে আশেপাশের অনেক আর্জেন্টাইনকে কাঁদতে দেখলাম। যদিও সৌদি আরবের সমর্থকদের চিৎকারে তখন স্টেডিয়াম রূপ নিয়েছে ঈদের আনন্দে! আর্জেন্টিনা সমর্থকদের যার সঙ্গেই কথা বলতে গেলাম তার চেহারাতেই দেখলাম রাজ্যের হতাশা আর অবিশ্বাস! সবার তখন একই হিসাব নিকাশ। আর্জেন্টিনা কি দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারবে?

স্টেডিয়াম থেকে সোজা ফ্যান ফেস্টিভ্যালে চলে এলাম। এখানে এসে দেখা গেল আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সেই দুঃখ আর হতাশা নেই। তারা এর আগেও ১৯৯০ প্রথম ম্যাচে হেরে বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল, এমন আলাপই চড়া।

কেউ কেউ দেখলাম- মরুর দেশে দুপুরের গরমে খেলা হয়েছে বলে আর্জেন্টিনা ঠিকমতো খেলতে পারেনি এমন অজুহাতও দিতে। পরের দুই ম্যাচে বিশাল ব্যবধানে জিতে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পথে ঠিকই এগিয়ে যাবে আর্জেন্টিনা, এমন বিশ্বাস তৈরি হলো দ্রুতই।  একটু আগে স্টেডিয়ামে মন খারাপ করা আকাশী সাদা যে স্রোত দেখেছিলাম ফ্যান ফেস্টিভ্যালে এসে তাদেরকেই দেখলাম মনে মনে আশার পাহাড় বানিয়ে বসে আছে।

কট্টর সমর্থকদের যুক্তি তর্কে কেউ হারাতে পেরেছে বলে আমি শুনিনি। তাই সৌদির কাছে হারের পর তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন আর আশায় নতুন কোনো প্রশ্ন করে দুরাশা হতে চাইনি। মনে তখন একটা ভাবনাই ঘুরাফেরা করছে, পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী মানুষ কারা- আর্জেন্টাইন সমর্থকরাই কি? ১৯৮৬ সালের পর থেকে প্রতিবারই তারা বিশ্বকাপে আসে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে! এমন আশা নিয়ে এত দীর্ঘ সময় থেকে কে কবে কিসের জন্য এই পৃথিবীতে অপেক্ষা করেছিল আর...!

লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক 

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

1h ago