কনটেইনার দিয়ে তৈরি অস্থায়ী স্টেডিয়ামে লাল-হলুদের মেলা
বিশ্বকাপ ফুটবল কি শুধুই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এক দলের বিপক্ষে আরেক দলের ফুটবল খেলা? যারা মাঠে বসে কখনো বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ দেখেননি তাদের কাছে বিশ্বকাপ ফুটবল স্রেফ বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্বের এক লড়াই মনে হতে পারে। কিন্তু যারা মাঠে বসে বিশ্বকাপ ফুটবলের একটি হলেও খেলা দেখেছেন তারা বিশ্বকাপ ফুটবলের অনেক মানে বের করতে পারবেন। আমার কাছে বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে- বিশ্ব সংস্কৃতির এক বিশাল বড় প্লাটফর্ম, মানুষে মানুষে সম্পর্কের এক নতুন সেতুবন্ধন।
কাল যেমন ব্রাজিল আর সুইজারল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচ দেখতে মাঠে ঢুকার পরই আমার ঠিক পাশেই আসন পড়েছিল সুইজারল্যান্ডের এক সমর্থক লরা'র। সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরের মেয়ে লরা দেশ থেকে কাতারে আসার সময় সুইজারল্যান্ডের অনেক পতাকা আর ক্যাপ নিয়ে এসেছে। আমি আমার আসনে গিয়ে বসতেই হাসিমুখে সে আমার হাতে সুইজারল্যান্ডের একটি পতাকা আর ক্যাপ ধরিয়ে দিলো। তারপর বললো 'যে দলই সাপোর্ট করো না কেন, সুইজারল্যান্ড গোল দিলে পতাকা নাড়াতে হবে।' আমি ফ্রি পতাকা আর ক্যাপ পেয়ে লরাকে বললাম, 'অবশ্যই'। তারপর লরাকে খুশি করতে সুইজারল্যান্ডের পতাকা হাতে নিয়ে একটি ছবিও তুলে ফেললাম।
এই যে আমি বাংলাদেশের একটা মানুষকে সুইজারল্যান্ডের একটা মেয়ে চিনে না জানে না, আবার কখনো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে- অথচ সেই কিনা আমাকে মাঠে বসে সুইজারল্যান্ডকে সমর্থন করার জন্য পতাকা আর ক্যাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে দিলো। এর আগে মরক্কোর ম্যাচে সেদেশের তরুণী বেনসি আমাকে মরক্কোর একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে কাজ করার রুমাল উপহার দিয়েছিল সুভ্যেনির হিসেবে। এই যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদান, মানুষে মানুষে সম্পর্কের সেতুবন্ধন- মাঠের খেলার বাইরে এটার জন্যও ফুটবল বিশ্বকাপ অনন্য!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এতদিন রেস্তোরা, রিসোর্ট এসব জাহাজে পণ্য পরিবহনের কনটেইনার দিয়ে তৈরি হতে দেখেছি। এবার দেখলাম কনটেইনার দিয়ে তৈরি বিশাল একটি স্টেডিয়াম। কনইেটনার দিয়ে তৈরি একটি স্টেডিয়াম কতটুকু দৃষ্টিনন্দন হতে পারে এটা এই স্টেডিয়াম স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। জাহাজে পণ্য পরিবহনের ৯৭৪ টি কনটেইনার দিয়ে তৈরি এই স্টেডিয়ামের নাম- স্টেডিয়াম ৯৭৪।
কাতার মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার সমৃদ্ধ একটি ধনী দেশ। একটি দেশ, অথচ আয়তনে আমাদের দেশের একটি বিভাগের সমান। সেই দেশ যখন বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় তখন অনেকের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। এত ছোট একটা দেশে হবে বিশ্বকাপ ফুটবল? অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাতার আয়োজন করে চলেছে চোখ ধাঁধানো এক বিশ্বকাপের। স্টেডিয়াম কোথায়, বিশ্বকাপের খেলা দেখতে যে লাখ লাখ মানুষ যাবে তাদের থাকার জায়গার ব্যবস্থা কি- বিশ্বকাপ আয়োজন করার সুযোগ পাওয়ার পর যখন চারদিকে উঠতে শুরু করেছে এমন সব প্রশ্ন তখনই কাতার হাতে নিয়েছে বিশ্বকাপ আয়োজনের এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনারই একটি অংশ ঝাঁ তকতকে একেবারে নতুন বিশাল বিশাল সব স্টেডিয়াম। সেই স্টেডিয়ামগুলোরই একটি- স্টেডিয়াম ৯৭৪! কিন্তু বিশ্বকাপের জন্য তৈরি আর সব নতুন স্টেডিয়াম পরবর্তী সময়ে থেকে গেলেও এই স্টেডিয়ামটি বিশ্বকাপের পর ভেঙ্গে ফেলা হবে। আর ভেঙ্গে ফেলার আগে এই স্টেডিয়ামটি সাক্ষী হবে বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটি ম্যাচের।
কাল ব্রাজিল-সুইজারল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে এই মাঠের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, প্রথম প্রবেশও। বিশ্বকাপের অন্যান্য স্টেডিয়ামে বেশ কয়েকটি খেলা এখনো পর্যন্ত দেখার সুযোগ হলেও এই স্টেডিয়ামে আসার সুযোগ হয়নি আগে। প্রথম দেখায় স্টেডিয়াম ৯৭৪ কে শুধু একটি স্টেডিয়ামই মনে হয় না, মনে হয় শিল্পীর আঁচড়ে তৈরি সাগরতীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো একটি শিল্পকর্ম। কাতার বিশ্বকাপের সবকটি স্টেডিয়ামই আসলে দৃষ্টিনন্দন। সবগুলোই মন ভরে দেখার মতো।
ব্রাজিল আর সুইজারল্যান্ডের সমর্থকদের নাচে-গানে কাল রাতে মেতে উঠেছিল এই স্টেডিয়ামের গ্যালারি। কিন্তু যারা হলুদ রঙে মাঠ মাতাতে এসেছিল সেই ব্রাজিলীয়রা প্রথমে মেতে উঠেছিল স্টেডিয়াম ৯৭৪ এর নানা রঙের মুগ্ধতায়। যেদিকেই চোখ গেছে সেদিকেই দেখেছি হলুদ নীল পোষাকে ব্রাজিলীয়রা একা একা অথবা দলবেঁধে ছবি উঠছে স্টেডিয়ামের বাইরে। ব্রাজিল সমর্থকদের এই উন্মাদনায় আলো ঝলমলে সাগরতীরের এই স্থাপনাটি তৈরির পর যেন প্রথম প্রাণ পেয়েছিল আর হলুদে-নীলের সঙ্গে নানা রঙের কনটেইনার মিলে পুরো স্টেডিয়ামের চারপাশে তৈরি করেছিল রঙে রঙে রঙিন এক জগত।
খেলা শুরুর আগে স্টেডিয়ামের বাইরে-ভেতরে ছিল উৎসব উৎসব একটা ভাব, নেইমারবিহীন ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে আক্রমণের পসরা সাজিয়েও ব্রাজিল যখন গোল করতে পারছিল না তখন হলুদ সমর্থকরা একটু দমে গিয়েছিলেন। কাসেমিরোর গোলে ব্রাজিলের জয়ের পর সেই উৎসব আবার ভাবটা পরিপূর্ণতা পায়।
বিশ্বকাপের ম্যাচ আয়োজন করে অনেক ইতিহাসের জন্ম দিয়ে ইতিহাসের অংশ যেমন হবে এই স্টেডিয়াম, ঠিক তেমনি বিশ্বকাপ শেষে যখন ভেঙ্গে ফেলা হবে তখন স্টেডিয়ামটি জায়গা করে নেবে আরেক ইতিহাসে। কারণ, এটিই বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম অস্থায়ী স্টেডিয়াম যেটি তৈরি করা হয়েছিল শুধুমাত্র বিশ্বকাপের ম্যাচ আয়োজনের জন্য! সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ৯৭৪ স্টেডিয়ামটি তৈরি করার সময় যে জাহাজে পণ্য পরিবহনের যে কনটেইনারগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, স্টেডিয়াম ভেঙ্গে ফেলার পর সেই কনটেইনারগুলো আবার ব্যবহার করা হবে পণ্য পরিবহনের কাজে। এছাড়া স্টেডিয়ামের অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে দেওয়া হবে বিশ্বের ফুটবল খেলুড়ে অনুন্নত দেশের ফুটবলের উন্নয়নে।
এই স্টেডিয়ামটি যখন তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয় তখন এটার নাম রাখা হয় রাস আবু আবউদ স্টেডিয়াম। কিন্তু পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয়- স্টেডিয়াম ৯৭৪। শুধু ৯৭৪টি কনটেইনার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে এই স্টেডিয়ামের নাম "স্টেডিয়াম ৯৭৪" নয়, কাতারের আন্তর্জাতিক টেলিফোন ডায়াল কোডও ৯৭৪!
ব্রাজিলের এক ঝাঁক তারকা ফুটবলারের নৈপুণ্যেই শুধু এই স্টেডিয়াম মাতেনি, আগামীকাল আর্জেন্টিনা-পোল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে এই মাঠে পা পড়বে বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের আরেক কিংবদন্তি লিওনেল মেসির! যে ম্যাচে জিতলে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণে একধাপ এগিয়ে যাবে মেসির আর্জেন্টিনা, আর যদি পোল্যান্ডের কাছে হেরে যায় তাহলে এখানেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে লিওনেল মেসি নামের এক ফুটবল কিংবদন্তির বিশ্বকাপ অধ্যায়। আর্জেন্টাইনরা এখন অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে স্টেডিয়াম ৯৭৪ এর দিকে, পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে জিতলে এখানেই তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা টিকে থাকবে, হেরে গেলে অপমৃত্যু হবে ৩ যুগ থেকে দেখে আসা একটি বিশ্বকাপ স্বপ্নের...।
লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক। লেখার ব্যবহৃত ছবি লেখকের।
Comments