চট্টগ্রাম থেকে

বাংলাদেশের ক্রিকেটে সৌম্য-ভ্রান্তি

সৌম্য সরকার

বৃহস্পতিবার দলের ঐচ্ছিক অনুশীলনের মাঝে নামে আচমকা বৃষ্টি, মাঝপথে অনুশীলন থামিয়ে দৌড় লাগান বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা। অবশ্য একজন ছাড়া। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেও সৌম্য সরকার নেট ছাড়তে চাইছিলেন না। আরেকটু অনুশীলনের তীব্রতা টের পাচ্ছিলেন তিনি। আগের দিন রান না পাওয়ায় তার চেহারায় ছিল প্রবল চাপ। 

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সৌম্য ৩ রান করে আউট হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধান কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ঘিরে তাকে করা হয় ট্রল। কোচের পছন্দের কারণেই তিনি দলে আছেন বলে প্রচারণাও প্রবল। সৌম্যের নিজের চোখও তা এড়াবার কথা না। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল প্রমাণের জেদ কাজ না করা অস্বাভাবিক না।

অথচ এক ইনিংস আগেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সৌম্য। সেসব বিস্মৃত হয়ে যায় দ্রুতই।  সেই ইনিংসের পর বেশিরভাগ মন্তব্য ছিলো- 'এক ইনিংসে ২০ ম্যাচ নিশ্চিত হয়ে গেছে।' আসলেই কি তেমন হয়?

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড় কে? এই প্রশ্ন করা হলে বেশিরভাগ উত্তর হয়ত আসবে সৌম্যের নাম। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার পারসেপশন এটাই। অথচ অভিষেকের ৯ বছর ৩ মাসে সৌম্য খেললেন কেবল ৬৮ ওয়ানডে। গত ৫ বছরে ১০টি।  এই ৬৮ ওয়ানডের ৬৪ ইনিংসে তিনি ২ হাজার রান স্পর্শ করে গড়ে ফেলেছেন রেকর্ড।

বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে তার চেয়ে দ্রুত ২ হাজার রান করেননি আর কেউ! এর আগে লিটন দাস ও শাহরিয়ার নাফিসের ৬৫ ইনিংস। সাকিব আল হাসানের ৬৯ ইনিংস ও তামিম ইকবালের এই মাইলফলক স্পর্শ করতে লেগেছিলো ৭০ ইনিংস।

এত অধারাবাহিক একজন ব্যাটার যদি দ্রুততম ২ হাজার রান করেন তাহলে প্রশ্ন উঠে দেশের ক্রিকেটের সার্বিক মান দিয়ে। ওয়ানডেতে সব মিলিয়ে সৌম্যের চেয়ে দ্রুততম ২ হাজার রান আছে আরও ৮১ জনের। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাকি সবারই অবস্থা এতে একটু পরিষ্কার হয় বৈকি।

Soumya Sarkar
সৌম্য সরকারের শট। ছবি: ফিরোজ আহমেদ

সৌম্যের নিজের যেমন অধারাবাহিকতা আছে তাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের অধারাবাহিকতাও একটা রেকর্ড। বাংলাদেশি ওপেনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪ শতাংশ পজিশন বদল করে খেলতে হয়েছে সৌম্যকে।

তাকে খেলানো হয়েছে তিন, চার, পাঁচ এমনকি সাতে। সৌম্যকে কখনো পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দেওয়া হয়েছে ফিনিশারের ভূমিকা। কখনো ভাবা হয়েছে মিডল অর্ডারে।

৬৪ ইনিংসের মধ্যে সৌম্য ওপেন করেছেন ৪২ ইনিংসে। তাতে তার গড় ৩৬.৯২ এবং স্ট্রাইক রেট ১০০.০৭। ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতায় তিনি বেশ কার্যকর থাকলেও সেখানে তার টানা খেলা হয়নি।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটারদের রেকর্ড নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা হয়। সহজ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলে পরিসংখ্যান ঋদ্ধ করা নিয়ে টিপ্পনি দেন সমর্থকরা। মজার কথা হলো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সৌম্য খেলেছেন স্রেফ দুই ম্যাচ। যেখানে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল খেলেছেন ৪৭ ম্যাচ, ওপেনিং ছাড়া তিনি আর কোন পজিশনেই খেলেননি। এই পরিসংখ্যান জানান দেয় বাংলাদেশ কত বেশি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেছে। হ্যাঁ, ওয়ানডেতে ওদের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৮১ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। সহজ এই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সৌম্যের মাত্র দুই ওয়ানডে খেলা বেশ অবাক করা বিষয়ই বটে। 

সৌম্য ৬৪ ইনিংসের সবগুলোতে যদি ওপেন করার সুযোগ পেতেন তাহলে দুই হাজার রান হতে পারত আরও অনেক আগে। তার নিজের ধারাবাহিকতার পাশাপাশি তাকেও যদি ধারাবাহিকভাবে আস্থা রাখা হতো তাহলে সমৃদ্ধ হতে পারত সৌম্যর ক্যারিয়ার, লাভ হতে পারত বাংলাদেশেরও। কারণ ৬৮ ওয়ানডের পরও সৌম্যের স্ট্রাইকরেট ৯৭.৪৮। বাংলাদেশের আর কেউ তার কাছাকাছিও নেই। কমপক্ষে ৫০ ম্যাচ খেলা ব্যাটারদের মধ্যে এরপর লিটনের স্ট্রাইকরেট ৮৬.৬৪। বাকি সবারই ৮০'র নিচে। বাংলাদেশের ব্যাটারদের গড়ও কারো ৪০ নয়।

শুক্রবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সৌম্য যখন ওপেন করতে নামেন তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, রান না করলেই জায়গা থাকবে না। নিজের চিরায়ত ঢঙে ৬৪ বলে ৬৮ রানের ইনিংস খেলেছেন। সেই ইনিংস আরও বড় হতে পারত। ওই ইনিংসের পথেই পেরিয়ে যান ওয়ানডের দুই হাজার রান।

বিশ্ব ক্রিকেটের বাস্তবতায় খুব বড় কোন ঘটনা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিচার করলে সৌম্য একদম ফেলনা ছিলেন না কখনই। তার শারীরিক গড়ন, হ্যান্ড আই কোর্ডিনেশনে বড় শট খেলার ক্ষমতা দেশের বাস্তবতায় বাকিদের চেয়ে আলাদা।  বরং তাকে পর্যাপ্তভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা যায়।

২০১৪ সালে সৌম্যের অভিষেকের পর বাংলাদেশ খেলেছে ১৫৮ ওয়ানডে। যার ৬৮টিতে খেলেছেন সৌম্য। অভিষেকের পর দারুণ ঝলক দেখানো বাঁহাতি ব্যাটারের জায়গা নড়ে যায় কয়েক বছরের মধ্যে। পরে শুধু ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে।

প্রথম ১৬ ম্যাচে তার গড় ছিলো ৪৯, স্ট্রাইকরেট ১০২। ২০১৬ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এক সিরিজে রান না পেতেই বাদ পড়েন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১৭ সালে ফিরে সুবিধা করতে পারেননি। তবে ২০১৮ সালে ৬ ম্যাচে ৪০ গড় আর ১০৪ স্ট্রাইকরেটে করেন ২৫৫। ২০১৯ সালে দলের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান করেও আর জায়গা পাননি দুই বছর।

২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৯ রানের ইনিংসের পর আর সুযোগ পান ২০২১ সালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাকে নামানো হয় ৭ নম্বরে। দুই ম্যাচে ব্যাটিং পাননি, আরেক ম্যাচে হন ব্যর্থ। আবার বাদ। এরপর ২০২৩ সালে বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে চার নম্বরে এক ম্যাচ খেলিয়েই বাদ। বিশ্বকাপে বাকিদের ব্যর্থতায় ফের ডাক পড়ে সৌম্যের। নিউজিল্যান্ডের মাঠে প্রথম ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর খেলেন ১৬৯ রানের ইনিংস।

সৌম্যের জন্য পুনর্জন্ম বলতে হয়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংসের জেরেই খেললেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আপাতত ৬৮ রান তাকে অন্তত দুই ম্যাচের গ্যারান্টি দিচ্ছে।

২০১৯ সালের পর পাঁচ বছরে বিভিন্ন সময়ে ১০ ম্যাচ খেলেছেন সৌম্য। আগামীতে তাকে ঘিরে দলের কি পরিকল্পনা দেখার বিষয়। নতুন নির্বাচক প্যানেল, নতুন টিম ম্যানেজমেন্ট সৌম্যকে কীভাবে কাজে লাগান তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুযোগ পেলে সৌম্য কীভাবে নিজেকে মেলে ধরেন তাও গুরুত্বপূর্ণ।

Comments

The Daily Star  | English

The ceasefire that couldn't heal: Reflections from a survivor

I can’t forget the days in Gaza’s hospitals—the sight of dismembered children and the cries from phosphorus burns.

5h ago