রপ্তানি তথ্যে বড় গরমিল, এলডিসি উত্তরণসহ আরও যত প্রশ্ন

ফাইল ফটো | সংগৃহীত

বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাব সংশোধন করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের অসঙ্গতির বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, এর আগে প্রায়ই বাংলাদেশের অর্থনীতির উজ্জ্বলতম দিক হিসেবে যে রপ্তানির কথা বলা হতো, সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক বছর ধরেই এই রপ্তানির পরিমাণ আসলে অতটা ভালো ছিল না।

প্রচলিত চর্চা অনুযায়ী, সাধারণত রপ্তানির তথ্য নেওয়া হয় কাস্টমসের শুল্ক পরিশোধের হিসাব থেকে।

বাংলাদেশে সরকারের তিনটি পৃথক সরকারি সংস্থা আলাদাভাবে রপ্তানির তথ্য সংগ্রহ করছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এই হিসাব রাখে। এর পাশাপাশি কাস্টমসের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি পণ্যের চালানের তথ্য থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এ হিসাব রাখছিল।

তিনটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য কমবেশি কাছাকাছি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে তিন সংস্থার তথ্যে যথেষ্ট গরমিল পাওয়া গেছে।

ইপিবির তথ্য ছিল দেশের রপ্তানির জন্য সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক। এটা সরকারি পরিসংখ্যান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। তাদের দেওয়া হিসাবে ইতিবাচক চিত্র ছিল, কারণ অসংখ্য চালানের প্রকৃত অঙ্ক তারা দ্বিগুণ বা তিনগুণ ধরে হিসাব করেছিল।

অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সরকার রপ্তানির হিসাব শুল্কের তথ্য থেকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেমনটি হওয়া উচিত ছিল আগেই।

রপ্তানির তথ্য সংশোধনের ফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের সমাধান মিলেছে। রহস্যটি ছিল, প্রতিবেদনে দেশের রপ্তানি বাজার নিয়মিতভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী দেখানো হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল না।

একইসঙ্গে দেখা গেছে, ভুয়া চালানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের কারণে ডলারের মজুত কমেনি। এনবিআর ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন কিছুই বলে আসছিল।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এবার রপ্তানির তথ্য সংশোধন করার পর কিছু অপ্রীতিকর প্রশ্ন সামনে এসেছে।

ইপিবির হিসাব কি তদারকি করা হতো না? কেন ইপিবি ও এনবিআর অর্থবছর শেষে তাদের তথ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে একসঙ্গে বসেনি? এই কেলেঙ্কারির জন্য কাকে দায়ী করা উচিত? নাকি এটা ইচ্ছা করেই এভাবে চলছিল এবং আইএমএফ বিষয়টি ধরার পর সরকার তার ভুল স্বীকার করে নিল?

এসবের পর দেশের অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন তথ্যের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দেশের অর্থনীতি গত এক দশকে একটি দৃঢ় অবস্থায় পৌঁছেছে বলে বারবার জানান দেওয়া হচ্ছিল, তা কি অসত্য ছিল?

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির দুই মূল চালিকাশক্তি। এই দুইয়ের ওপর ভিত্তি করে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বছরের পর বছর ধরে বলছিল সরকার।

এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এতদিন দেশের প্রকৃত জিডিপি হিসেবে যা দেখানো হচ্চিল, তা প্রকৃতপক্ষে অনেক কম। দেশের জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে শিল্প উৎপাদন থেকে, যার ভিত্তি মূলত রপ্তানি পণ্য।

এবার আরও একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়—বাংলাদেশ কি সত্যিই ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুত?

বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের পথ তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের ওপর ভিত্তি করে। এখন যেহেতু অর্থনৈতিক তথ্যের বড় গরমিল ধরা পড়েছে, তাই এলডিসি উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমাও নতুন করে নির্ধারণ করা দরকার হতে পারে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্ববাজারে যেসব বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করছে তা হারাবে। এতদিন বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে দেশের রপ্তানি খাত যতটা না এগিয়েছে, তার চেয়ে বেশি করে আসলে দেখানো হয়েছে। রপ্তানিকারকরা কি বাণিজ্য সুবিধা ছাড়া ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন? আমাদের রপ্তানি কি আরও কমে যেতে পারে?

গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বেশ উচ্ছ্বসিত ছিল।

আরও একটি ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে—রপ্তানি তথ্য সংশোধন করার পর বড় ক্ষতিটা অর্থনৈতিক নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক। এখন পর্যন্ত রপ্তানির নিট হিসাব ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এতে সরকারের সব তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

রপ্তানির তথ্য যদি এভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের অবস্থা তাহলে কী? দারিদ্র্য বিমোচন বা সামাজিক উন্নয়ন সূচকে যে অগ্রগতির কথা বলা হচ্ছে, তার প্রকৃত অবস্থা কী?

গত এক দশকের সব অর্জনই এখন প্রশ্নবিদ্ধ যে, চকচক করলেই সোনা হয় না।

এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার প্রথম ধাপ অবশ্যই ভুল স্বীকার করে নেওয়া। যেহেতু সরকার ভুল স্বীকার করেছে, এখন অবশ্যই রপ্তানি হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি প্রতিবেদন নতুন করে তৈরি করতে হবে।

অন্তত এতদিনের জিডিপির হিসাব নতুন করে তৈরি করতে হবে। নতুন করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন ছাড়াও আরেকটি আশার দিক হলো—দেশের অর্থনীতিতে কর-জিডিপি অনুপাত, যা দীর্ঘসময় ধরে বিশ্বের সর্বনিম্ন এবং আমাদের অর্থনীতির দুর্বল জায়গা ছিল। এক্ষেত্রে অবশ্যই একটা ভালো অবস্থা ফিরে আসতে পারে।

জিডিপির হিসাব নতুন করে তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য তার একটি ভালো দিকও থাকবে। সরকারের নেওয়া ঋণের বেশিরভাগ এই জিডিপি পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে এবং এতদিন এসব ছিল অরেয়াতযোগ্য, যে কারণে ঋণের সুদ পরিশোধ করা সরকারের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতি থেকেও উত্তরণ সম্ভব, যদি সরকার এখনকার অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়।

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at Secretariat building no 7

A fire broke out at the Secretariat building number 7 in the capital's Segunbagicha area early today. ..At least 11 firefighting units are working to control the fire. ..According to Prothom ALo, fire service received information about the fire at 1:52am. Firefighters arr

4h ago