আর কত দিন বন্ধ থাকবে কুয়েট?

১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম সকালে এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন আমার মন পড়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। যে ক্যাম্পাসে আমি উপভোগ করেছি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো। যে চত্বরে আমি ভিন্ন আবিরে রাঙিয়েছি বাংলা বছরের প্রথম দিনসহ বিভিন্ন উৎসব আয়োজন। এখনো স্পষ্ট মনে আছে নতুন বছর উপলক্ষ্যে হলের ডাইনিংয়ে বিশেষ খাবার, বন্ধুদের সঙ্গে মল চত্বরে আড্ডা, কারও জন্য অধীর অপেক্ষা, লাল-সাদা পাঞ্জাবি, লাল-সাদা শাড়ি, ভিন্ন ভালোলাগায় ভেসে যাওয়া আরও কত কী! সত্যিই নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব আয়োজনে মেতে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক বিশেষ উপলক্ষ।

কিন্তু নতুন বছরের প্রথম দিনেই মন খারাপ করা একটি খবর নজরে এলো। প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অনির্ধারিত, আত্মবিনাশী এই বন্ধে শিক্ষার্থীরা সঙ্গত কারণেই অস্থির হয়ে পড়েছেন। তৈরি হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তা। যার অবসান ঘটাতে গতকাল রোববার শিক্ষার্থীরা বন্ধ থাকা ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির আবাসিক হলে প্রবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। বিপরীতে শিক্ষার্থীরা যাতে বন্ধ ক্যাম্পাসে না ফেরেন, সেজন্য তৎপরতা শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধু তাই নয় দৈনিক প্রথম আলোর খবর বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাধিক সভা, প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি, বিজ্ঞপ্তি জারি ও অভিভাবকদের মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে না পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে।

পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ঠেকাতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আবাসিক হলগুলো আগে থেকেই সিলগালা। কী ভীতিকর পরিস্থিতি, যাদের ক্যাম্পাস, যারা ক্যাম্পাসের প্রাণ, সেই শিক্ষার্থীরা যাতে নিজের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য প্রধান ফটকে পুলিশ মোতায়েন! এমন উদ্ভট ভীতিকর পরিস্থিতি বাংলাদেশের আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটেছে কি না, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। যদিও পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো—পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রঙিন আয়োজনে মগ্ন থাকতে পারতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

একটু পেছন ফিরে দেখা যাক, চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

'কুয়েট-১৯' নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে কুয়েট শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়। গতকাল রাতে ওই পেজে বলা হয়েছে, 'সকল কুয়েটিয়ানকে ঠিক দুপুর ২ ঘটিকায় কুয়েট মেইন গেটে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে সবাই আইডি কার্ড বা লাইব্রেরি কার্ড সাথে রাখব'। অন্যদিকে কুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে আজ 'লং মার্চ টু কুয়েট' কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একবার চিন্তা করে দেখুন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীদের কত কী করতে হচ্ছে! অথচ অন্তবর্তী সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিক হলে অনেক আগেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারতো। কিন্তু সংকট সমাধানে প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতার বদলে প্রশাসন হাঁটছে উল্টো পথে।

এরইমধ্যে কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেছেন নগরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার হোচেন আলী নামের এক ব্যক্তি। এই মামলায় অজ্ঞাত আসামি আরও ১৫-২০ জন। প্রায় দুই মাস পরে এসে দায়ের করা এই মামলাকে আমার কাছে ষড়যন্ত্রমূলক বলে মনে হয়। এর পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগও করছেন, কুয়েট প্রশাসন উসকানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে। অন্যদিকে সংঘর্ষের দিনও খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন।

সংকট সমাধানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে মামলা ও পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত রীতিমতো হঠকারিতা। এটা ফ্যাসিবাদী আচরণ। এতে সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অমূল্য শিক্ষাজীবন। এই দায়ভার বর্তমান উপাচার্য ও অন্তর্বর্তী সরকারের।

এখানে আরেকটি জরুরি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। গত বছরের জুলাই-আগস্টে মূলত ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। পতিত এই শাসকের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করতো ছাত্রলীগ। যাদের কর্তৃত্বে ছিল দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়। তারা ক্যাম্পাসগুলোতে রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এর বিপরীতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে ভয়হীন, সংঘাতমুক্ত শিক্ষাঙ্গই সবার কাম্য। তাই নিরাপদ শিক্ষাঙ্গণ নিশ্চিত করতে সবারই দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। সহাবস্থান ও সহনশীলতা বিপরীতে ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলো যদি সংঘাতের পথ বেছে নেয়, সেটা হবে চরম আত্মঘাতি। এই পথে হাঁটলে অতি দ্রুত জুলাই চেতনার অপমৃত্যু ঘটবে।

আরও একটি জরুরি বিষয়, কোনো কিছু ঘটলেই যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করা যৌক্তিক নয়, আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে উপাচার্যের পদ আকড়ে থাকাও লজ্জার। এতে সব পক্ষের ক্ষতি। অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে দ্রুত খুলে দেওয়া হোক খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একইসঙ্গে মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রয়োজন। এরমধ্যেই অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। আর নয়, প্লিজ!

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

18h ago