আরেকটি ভেটোয় দীর্ঘায়িত হলো গাজায় গণহত্যা
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/02/23/ed_1_-_rafah_-_reuters.jpg?itok=D61JG0Y9×tamp=1708677677)
গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আমার সর্বশেষ কলাম 'ইসরায়েলের "আত্মরক্ষার অধিকার" ও ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর নিয়তি' লেখার পর প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেলেও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং আরও খারাপ হয়েছে। কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চলছে এবং এই মুহূর্তে রাফাহর লাখো মানুষ গণহত্যার সম্মুখীন হতে চলেছেন। ইতোমধ্যে সেখানে বোমাহামলা চলছে এবং স্থল হামলার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে, ফিলিস্তিনি সূত্রমতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ২৯ হাজার ৩১৩ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৬৯ হাজার ৩৩৩ জন আহত হয়েছেন।
তবে, সবচেয়ে ভয়াবহ যে তথ্যটি আমাদের সামনে এসেছে তা হলো, এই হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, গত সাড়ে চার মাস ধরে প্রতিদিন প্রায় ৭০টি শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। যখন এই কলাম লিখছি, তখন রাফাহর ওপর বোমাহামলার তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে ইসরায়েল।
গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য সর্বশেষ আলজেরিয়ার প্রস্তাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৩ সদস্য রাষ্ট্র সমর্থন জানালেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং ভোটদানে বিরত থাকে যুক্তরাজ্য। এর থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যাই বলুক না কেন, শিশুসহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মোটেই চিন্তিত নয়।
এই ভেটোর ক্ষেত্রে অজুহাত দেওয়া হয়েছে যে, এ ধরনের উদ্যোগে ইসরায়েল, মিশর ও কাতারের মধ্যে চলমান আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। এর অর্থ কি এটাই নয় যে, যতদিন পর্যন্ত এই আলোচনা চলতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত গাজায় নারী ও শিশুসহ ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকবে? এমনকি, এই যুক্তিও আসতে পারে যে আরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার জন্য ইচ্ছা করেই ইসরায়েল এই আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করতেই থাকবে।
এতদিনে এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা থেকে ধারণা করা যায় যে ইসরায়েলিরা যত বেশি সম্ভব গাজাবাসীকে হত্যা করে এবং বাকিদের মিশরের সিনাই অঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়ে গাজা উপত্যকাকে জনশূন্য করতে চায়। যা গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের এক সমন্বিত রূপ এবং এর নজির মানব ইতিহাসে খুবই বিরল। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সুস্পষ্ট লক্ষ্য হলো এই ভূখণ্ড দখলে নেওয়া।
স্থল অভিযান শুরু হওয়ার পর গাজাবাসীদের উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে সরে যেতে বলে ইসরায়েলিরা। যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষিণ গাজার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর নিরবচ্ছিন্ন বোমাহামলায় উত্তরের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস করে ইসরায়েল।
দক্ষিণে গাজাবাসীরা সরে আসার পর কিছু এলাকাকে 'নিরাপদ' ঘোষণা করে বাকি সব জায়গায় বোমাহামলা অব্যাহত রাখে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে, মিশরের সীমান্তে অবস্থিত রাফাহ শহরে লাখো ফিলিস্তিনি জমায়েত হওয়ার পর এখন সেখানে দুই সপ্তাহের মধ্যে স্থল হামলা শুরুর হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। যদি এই সময়সীমার মধ্যে হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়া হয়, তাহলে রমজান থেকে এই হামলা শুরু হবে। কিন্তু এই শর্ত মানলেও ইসরায়েল এই অঞ্চল থেকে সরবে না—এমন দাবিকে 'বিভ্রান্তিকর' বলেছে ইসরায়েল।
গত ৭৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে নিজেদের সীমানা বড় করে চলেছে ইসরায়েল। এর জন্য ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে বা বিতাড়িত করা হচ্ছে তাদের জন্মভূমি থেকে।
জাতিসংঘ ভাগ করার আগে ফিলিস্তিনে ইহুদীরা ছিল সংখ্যালঘু। তারপরও ১৯৪৭ সালে ইহুদী রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনের ৫৫ শতাংশ ভূখণ্ড ও স্থানীয় আরবদের ৪৫ শতাংশ ভূখণ্ড দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে সব আরব রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ৭৮ শতাংশ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে প্রায় পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডই ইসরায়েলের দখলে চলে যায়।
তখন থেকেই পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, গোলান মালভূমি ও পূর্ব জেরুজালেমকে সারা বিশ্ব অধিকৃত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে, কিন্তু ইসরায়েল এমন ভাব দেখায় যেন এসব অঞ্চল তাদেরই।
ইসরায়েল অবৈধ 'বসতি স্থাপন' নীতির মাধ্যমে, বিশেষত পশ্চিম তীরে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, রীতি ও জাতিসংঘের সনদকে অবজ্ঞা করে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড দখল করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদনে ইতোমধ্যে গোলান মালভূমি ও পূর্ব জেরুজালেমকে গ্রাস করে নিয়েছে ইসরায়েল।
আশা করি এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে পাঠকরা অন্তত এটুকু বুঝতে পারছেন যে গাজা উপত্যকার দখল নেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের সিনাই চলে যেতে বাধ্য করার বিষয়টি ইসরায়েলের বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ, যা নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থী সরকার অবর্ণনীয় নৃশংসতায় বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে সম্ভবত সবচেয়ে ভয়াবহ যে বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে তা হলো, নেতানিয়াহুর সরকার ও তার সমর্থকরা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ঠিক কতটা ঘৃণা করে। এটা সবচেয়ে পাশবিক জাতিবৈষম্যের লক্ষণ। এই হত্যাকাণ্ড আমাদেরকে ইহুদীদের ওপর নাৎসিদের আচরণের কথা মনে করিয়ে দেয়।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, হিটলারের ইহুদী গণহত্যা বা হলোকাস্ট সারা পৃথিবীজুড়ে নিন্দিত ছিল এবং এখনো নিন্দিতই রয়েছে। এর ফলে ইহুদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারা বিশ্বের সমবেদনা পেয়েছে। অথচ, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সেই একই আচরণ করে যাচ্ছে কট্টর ডানপন্থী জায়োনিস্টরা।
আমাদের চিন্তাধারায় কারো প্রতিই কোনো ধরনের বিদ্বেষ রাখা উচিত না। ঠিক তেমনি, সব ধরনের জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত।
সার্বিকভাবে এ কথা বলাই যায় যে ইসরায়েলের এই নিরবচ্ছিন্ন জাতিগত নিধন, নির্বিচারে নারী ও শিশুসহ ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ হত্যা, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর, স্কুল, এমনকি হাসপাতাল ধ্বংস করে দেওয়া এমন এক পর্যায়ের অমানবিকতাকে প্রকাশ করছে যা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকাস্টের পর আর দেখিনি।
এর পাশাপাশি আরও এক ধরনের ক্ষতি হয়েছে, যা সবার জন্য বড় ক্ষতি—তা হলো, পশ্চিমা শক্তির, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান, গুরুত্ব, মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষয়। কারণ, তারা লজ্জাজনক, অমানবিক ও ব্যাখ্যাতীতভাবে এই আগ্রাসন এত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে দিচ্ছে।
মানবাধিকার, শিশু অধিকার, নারীর অধিকার এবং সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন—যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের পর ধীরে ধীরে গত কয়েক দশক ধরে তৈরি করা হয়েছে, তার সবই আজ প্রশ্নবিদ্ধ এবং ইসরায়েলের এসব কার্যক্রম ও পশ্চিমাদের অন্ধ সমর্থনে বিষয়টি মাত্রাহীন প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েল শুধু হামাসের বিরুদ্ধে লড়ছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নয়—ইসরায়েলের দেওয়া এই খোঁড়া যুক্তি পশ্চিমা বিশ্ব বিনা প্রশ্নে মেনে নিচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা ও তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরা হলে জবাব আসছে, হামাস বেসামরিক স্থাপনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের সুরক্ষিত রাখে এবং এ কারণে এই হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসের কোনো বিকল্প নেই।
যখন প্রশ্ন তোলা হয় যে হাসপাতালে কেন বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে? তখন তারা তাদের পছন্দের কিছু মানুষের সামনে সুড়ঙ্গ 'উন্মোচন' করে দাবি করে যে এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে হামাস হামলা চালায় এবং এ কারণে রোগী ভর্তি থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালগুলোতে বোমাহামলা চালানোর যুক্তিসংগত।
হাসপাতালে হামলা চালানোর আগে রোগীদের হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু রোগীরা কোথায় যাবেন এবং কীভাবে যাবেন? কীভাবে গুরুতর আহত ও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকা রোগীরা সরে যাবেন? কীভাবে বোমার আঘাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো শিশু ও বড়রা সরে যাবেন? যেখানে স্থলবাহিনীর যোদ্ধারা যেকোনো সময় চাইলেই প্রবেশ করতে পারে, সেখানে কেন নির্বিচারে বোমাহামলা চালানোর প্রয়োজন হচ্ছে?
আরও একটি প্রায় সমান পরিমাণ ক্ষতি হলো, পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো। এটা সাংবাদিক হিসেবে আমাদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ।
পশ্চিমা গণমাধ্যম যদি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তাহলে তা পরোক্ষভাবে হলেও পুরো গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মোটা দাগে প্রভাবিত করবে। কোনো ধরনের নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ, ইসরায়েলি হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে একপাক্ষিক সংবাদ প্রচার ও তাদের ভয়াবহ সহিংসতার নামকাওয়াস্তে সমালোচনা—এসব কিছুই সার্বিকভাবে সব গণমাধ্যম, বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রতি গভীর ও সার্বজনীন আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে, সবার মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা তৈরি করেছে এবং ফলস্বরূপ, সব জায়গায় ভুয়া ও মিথ্যা সংবাদের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।
সারা বিশ্বকে একতাবদ্ধ হয়ে জেগে উঠে ফিলিস্তিনকে বাঁচাতে হবে। আমাদের সভ্যতা যেসব মৌলিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোকে ধরে রাখতে হলে নিশ্চিত করতে হবে যে 'ন্যায়ের' বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেন 'পেশীশক্তির' জয় না হয়। মানবতার সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা দেওয়া। এই দায়িত্বে ব্যর্থ হলে তার চরম মূল্য দিতে হবে; সারা বিশ্বে বেড়ে যাবে সহিংস, অবৈধ ও অমানবিক কার্যক্রম।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments