অস্থির পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শিক্ষা

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

যেভাবে একটি দেশ পরিচালনা করা উচিৎ নয়— তা উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। পাকিস্তানের রাজনীতি এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি— বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দুই বছরের ধ্বংসাত্মক করোনা মহামারির পর দেশ দুটির মানুষকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নাক গলানো এবং শ্রীলঙ্কায় অভিজাত শাসকগোষ্ঠী তাদের দেশের জনগণের প্রয়োজনের প্রতি নিঃস্পৃহ থাকার বিষয়টি অব্যাহত রেখেছে। এ দুটি কারণই মূলত পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান সময়ের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

যখন পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চোরাবালিতে আটকে ছিল, তখন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে যাচ্ছে। যা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মডেল হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি এ কথা বলেছেন। মহামারি ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ওঠানামার মধ্যেও গত কয়েক দশকে আমাদের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিশেষত শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং দেশের মানুষের সহনশীলতা ও সৃজনশীলতাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন বাইডেন। তারপরও যদি মনে করি সামনে সবকিছুই আমাদের জন্য কুসুমাস্তীর্ণ হবে, তাহলে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি। এই দুই দেশের সংকট থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।

শ্রীলঙ্কাকে একসময় আমাদের এই অঞ্চলের সম্ভাব্য সিঙ্গাপুর হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু দেশটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অমার্জনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং নিজ দেশের জনগণ এবং একইসঙ্গে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের স্তম্ভিত করেছে। যে বিষয়টি কয়েক দিন আগেও অচিন্তনীয় ছিল, তা আজ বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মানুষ এখন খাদ্য ও জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য মৌলিক উপকরণের অভাবে ভুগছেন। এরকম এর আগে কখনো শোনা যায়নি যে, একটি দেশ কাগজের অভাবে তাদের স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষার আয়োজন করতে পারেনি। কিন্তু এমনটাই ঘটেছে শ্রীলঙ্কায়।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান সমস্যাগুলোর মূল কারণ অপরিকল্পিত অব্যবস্থাপনা, চাটুকারিতার সংস্কৃতি ও দীর্ঘকাল অভিজাত পরিবারের ক্ষমতায় থাকা। শতভাগ স্বাক্ষরতা ও মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বের প্রথম দিককার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল শ্রীলঙ্কা। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি এবং দেশটির গণপরিবহন ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের মান এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য ছিল ঈর্ষণীয়। দেশটির দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধের কথা বাদ দিলে, দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের তুলনায় এ দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল।

সবচেয়ে মারাত্মক ভুল যেটা ছিল, তা হলো- গুটিকয়েক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের ঘুরে-ফিরে বার বার ক্ষমতায় আসা। যারা দেশের জনগণের প্রতি লোক দেখানো দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে। এই পরিবারগুলো গণতন্ত্রকে এমন এক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল, যে সময়মত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বা সংস্কার আসেনি। কোনো সরকারই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, মৌলিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার অথবা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এ ধরনের সংস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়নি।

সম্ভবত একটি পরিবারের একটি দেশ দখল করে নেওয়ার সবচেয়ে স্থূল এবং অনন্য উদাহরণ হলো রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতায় ফেরার বিষয়টি। প্রেসিডেন্ট (যিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীও), প্রধানমন্ত্রী ও সদ্য সাবেক হওয়া অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন ৩ ভাই। দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদগুলো তাদের নিকট আত্মীয়রা দখল করে রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাহিন্দা রাজাপাকসের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিসভা ছাড়াও সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে তার পরিবারের ৪০ জন সদস্য ছিলেন।

বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় শুধু নামকাওয়াস্তে একটি সরকার রয়েছে।

গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন ইমরান খান। পাকিস্তানের স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ১২টার দিকে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি শুরু হয়। এর কিছু সময় পর ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়। অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়ে ১৭৪টি। ৩৪২ আসনের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবটি পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট।

আর্থিক দুরবস্থা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবটি এনেছিল বিরোধী দলগুলো। এ অনাস্থা প্রস্তাবকে 'অসাংবিধানিক' আখ্যা দিয়ে ৩ এপ্রিল খারিজ করে দেন জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এতে চরম রাজনৈতিক সংকটে পড়ে পাকিস্তান।

এ অবস্থায় স্বতঃপ্রণোদিত নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। বিরোধীরাও আদালতের শরণাপন্ন হন। টানা ৫ দিনের শুনানি শেষে গত বৃহস্পতিবার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। একইসঙ্গে গতকাল অনাস্থা প্রস্তাবের সুরাহার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ।

এ মুহূর্তের নাটকীয় পরিস্থিতির পেছনের কারণ যাই হোক না কেন, অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে পর্দার অন্তরালে থেকে সামরিক বাহিনীর কলকাঠি নাড়ানোর বহুল প্রচলিত রাজনৈতিক চর্চা। পাকিস্তানের জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয় হচ্ছে, তাদের সরকারগুলোর গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে যত ভালোই হোক না কেন, সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া তারা কাজ করতে পারে না। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের অস্তিত্বের ২৫ বছরই সামরিক বাহিনী সরাসরি দেশ শাসন করেছে। আর বাকি সময়টা তারা বেসামরিক সরকারের নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছে। কখনোই তারা গণতান্ত্রিক এজেন্ডা নিয়ে জনগণের স্বার্থকে সামরিক বাহিনীর স্বার্থের ওপরে রাখতে পারেনি। ফলে নির্বাচিত সরকারগুলো বাধ্য হয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানোর পরিবর্তে প্রতিরক্ষা খাতের দিকে প্রবাহিত করতে।

যতক্ষণ পর্যন্ত তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সামরিক বাহিনীর নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে না পারছে এবং কারা তাদেরকে নেতৃত্ব দেবে, তা স্বাধীনভাবে নির্বাচন করে নেতাদেরকে তাদের আইনি ভূমিকা পালন করতে না দিতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষার বিষয়ে বলা যায়, গত বুধবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, আমাদের শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তার কারণ আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি শক্তিশালী এবং আমাদের ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া প্রায় নিখুঁত। আমরা তার বক্তব্যের মূল ভাব ও আত্মবিশ্বাসী মনোভাবের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। তবে একইসঙ্গে আমরা মনে করি, কিছু বিষয়কে আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার। যেগুলোর দিকে গুরুত্ব সহকারে নজর দিতে হবে।

এ বিষয়ের সঙ্গে যেটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা হলো— আমাদের অর্থনীতি মূলত উপার্জনের দুটি মৌলিক উৎস, তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। স্বভাবতই বাজার পরিস্থিতির ওঠানামার ওপর আমাদের অর্থনীতি অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার বিষয়টিকে ছোট করে দেখা একেবারেই উচিৎ হবে না। বৈশ্বিক পর্যায়ে চাহিদা ও দামের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য ওঠা-নামা আমাদের দেশে দুর্ভোগ ও সংকটের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের অনেক বড় আকারে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ, কারণ তারা শুধু করোনাভাইরাসের হুমকি সামলাননি, একইসঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ মাসের মধ্যে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনের সময় তৈরি পোশাক খাতের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী ইতিবাচক ফল পেয়েছি।

রেমিট্যান্স হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার আরও একটি উৎস, যা মহামারির মধ্যেও অব্যাহত ছিল এবং আমাদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখেছে। কিন্তু এটিও অল্প কয়েকটি বাজার, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমাদেরকে এই নির্ভরশীলতা কমাতে হবে এবং আমাদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। যাতে তারা আরও বেশি রোজগার করতে পারেন। এ বিষয়ের ওপর জরুরিভিত্তিতে নজর দিতে হবে।

মেগাপ্রকল্প অনেক দেশের অর্থনৈতিক অধঃপতনের কারণ হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাতারাতি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তাড়াহুড়ো করে বড় আকারের অবকাঠামোগত প্রকল্পের দিকে নজর দেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের পরিবর্তে চাকচিক্য এবং প্রতিপত্তির প্রতি আসক্তি প্রায়ই তাদের এদিকে পরিচালিত করেছে।

আমাদের ক্ষেত্রে মেগাপ্রকল্পগুলোতে বড় আকারের বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমরা যদি সবচেয়ে বড় ১০ প্রকল্পের (পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল লিংক, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-৬, পায়রা সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল, দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার সড়ক রেল লিংক, ঢাকা-সিলেট করিডর এবং মহেশখালী-মাতারবাড়ী উন্নয়ন প্রকল্প) খরচ যোগ করি, তাহলে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮১ হাজার ৭০৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এটি একটি বিশাল অংকের টাকা। আমাদের প্রত্যাশা, এ প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতিতে ও সার্বিক অবকাঠামোগত দিক দিয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে। প্রশ্নাতীতভাবে, আমাদের এ প্রকল্পগুলো প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে আমরা তহবিল জোগাড় করি এবং কতটা যুক্তিযুক্তভাবে আমরা তা ব্যবহার করি, সেটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন।

এ ক্ষেত্রে কত টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেটা সমস্যা নয়, বরং উপযোগিতার সঙ্গে এবং সময়মত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে কী না, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে আমরা সক্ষমতা বাড়িয়ে ঋণের বোঝা কমিয়ে আনতে পারি এবং প্রকল্পগুলোকে আরও কার্যকরী করে তুলতে পারি। কিন্তু এ ক্ষেত্রেই আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দৃশ্যমান হয়ে সামনে আসে। ছোট ও মাঝারিসহ আমাদের বেশিরভাগ মেগাপ্রকল্প সময়মত বাস্তবায়ন হয় না। এক থেকে চার বারও প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে সম্ভাব্য আয়ের সুযোগ কমে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আমরা যদি দুর্নীতি ও অপচয়কে বিবেচনা করি, তাহলে এই খরচ আরও বেড়ে যায়। এখানে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কেন এই মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সেই জবাবদিহি করতে হয় না।

এরপর আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সমন্বয়। একটি প্রকল্প, বিশেষ করে বড় প্রকল্পের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা থাকে। যদি প্রকল্পের সবগুলো বিষয়ে সমন্বয় থাকে না। ফলে খরচ আরও বেড়ে যায় এবং অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে একটি জীবন্ত উদাহরণ হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। আমাদের এখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য সঞ্চালন লাইন তৈরি না থাকায় এই সক্ষমতা পুরোপুরি অকার্যকর। এখন করদাতারা বাধ্য হচ্ছেন এই বাড়তি সক্ষমতার খরচ বহন করতে আর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো অলস হয়ে বসে থাকছে। গত অর্থবছরে, সরকার (বস্তুত, করদাতারা) ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের খরচের চেয়ে বেশি) সক্ষমতার খরচ হিসেবে এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে দিতে বাধ্য হয়েছে। এর আগের বছর, এই পরিমাণটি ছিল ৮ হাজার কোটি টাকা (পায়রা সমুদ্র বন্দরের মোট খরচের অর্ধেক)। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরও একই পরিস্থিতি। তাদের এক সময় অনেক বেশি গন্তব্য ছিল, কিন্তু সে তুলনায় উড়োজাহাজের সংখ্যা ছিল কম। কিন্তু এখন তাদের অনেকগুলো উড়োজাহাজ, কিন্তু সে তুলনায় গন্তব্যের সংখ্যা কম। যখন আমরা নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করি কিংবা ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেই, তখন আমরা বিষয়গুলো ভালো করে ভেবে দেখিনি।

হয়তো আমরা অদূর ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হব না, কিন্তু এখনো আমাদের অর্থনীতি ও সুশাসন প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট পরিমাণ দুর্বলতা আছে। যার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments