ছাত্ররাজনীতি: সহিংসতা পুরস্কৃত, মেধা তিরস্কৃত

কেন আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছি? অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও দলীয় রাজনীতির অংশ করে ফেলা কি ছাত্রসমাজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দেওয়া নয়? কোনো শিক্ষার্থী যতদিন দলের পেশিশক্তি বাড়াতে চাইবে, ততদিন সে শিক্ষার্থী হিসেবে যাই করুক না কেন, সেটা গ্রহণযোগ্য—এটা কি আমাদের অবস্থান হতে পারে?

দেশ হিসেবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে এমন অনেক বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। যেমন: জলবায়ু সংকট, মহামারি, ভূ-রাজনীতি, বিশ্বায়ন, জ্বালানি সংকট, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি। কিন্তু কিছু বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। যেমন: আমাদের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলা। বিশ্ব সেরা না হলেও অন্তত এই অঞ্চলের সেরা হিসেবে তাদের গড়ে তোলা যেতেই পারে। এই কাজেও যখন আমরা ব্যর্থ হই এবং জেনে-বুঝেও বার বার বিপরীত কাজটাই করতে থাকি, তখন প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি না এবং একই প্রক্রিয়ায় দেশের ভবিষ্যতকেও কি বিপন্ন করছি না?

আমি আমাদের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত এবং এর গুরুত্ব ও ইতিবাচক তাৎপর্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমার বিশ্বাস, শিক্ষার্থীরা যা দেখছেন, সেখানে প্রয়োজনে প্রশ্ন তোলা উচিত এবং কোথাও কোনো অবিচার, নিপীড়ন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার দেখলে তার প্রতিবাদ করা উচিত। পরিস্থিতির প্রয়োজনে পরিবর্তনের দাবিও তারা জানাতে পারেন।

কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের এটাও জানতে চাওয়া উচিত, যে ছাত্র আন্দোলন ছিল আমাদের গর্বের বিষয়, তার কী পরিণতি হয়েছে? বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে কি ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, অন্যের অধিকারের মতো বিষয় কোনো গুরুত্ব বহন করে? আধুনিক জীবনের জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তারা কতটা সচেতন? যে জলবায়ু সংকটের কারণে মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে, সে বিষয়ে তারা কতটুকু জানে? তারা কি জানে, তাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকা একটি দেশ? তারা কি মনে করে যে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ? ভিন্নমত পোষণকারীদের সঙ্গে আলোচনা করাকে কি তারা অর্থবহ মনে করে? কেন সহিংসতাই তাদের প্রথম পছন্দ? তারা যে শিক্ষা পাচ্ছে, সেখান থেকে কী ধরনের মূল্যবোধ, স্বপ্ন ও আদর্শ তারা ধারণ করছে? ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ভালো প্রস্তুতি নিতে এই তরুণদের উপযুক্ত দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কী? তারা কি কখনো ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করে? যদি করে থাকে, তাহলে সহিংসতায় মত্ত থেকে কীভাবে ভালো ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব?

ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে চলা সংঘর্ষের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টারে। এসব প্রতিবেদন দেখে আমার মনে আরও কিছু প্রশ্ন জেগেছে। এই ৩টি কলেজই নগরীর অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটিরই রয়েছে প্রশংসনীয় ফলাফলের ধারা। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও সফল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। সিটি কলেজ বাণিজ্য বিষয়ে অন্যদের থেকে বেশ এগিয়ে এবং আইডিয়াল কলেজের সার্বিক অবস্থানও সন্তোষজনক। ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিউমার্কেট, গ্রিন রোড ও ধানমন্ডি রোডের আশেপাশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত এলাকায় অবস্থিত। আমাদের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে বাকিগুলোর অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েই যায়।

আমরা আসলে তাদের কী শিক্ষা দিচ্ছি? আমরা যা শেখাই, তা থেকেই বা তারা আসলে কতটুকু শিখছে? আমরা কি তাদেরকে একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করছি? 'একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক' বলতে কী বোঝায়, তা কি আমরা সত্যিই বুঝি? আমরা জানি, এটা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত (এআই) সমাজ। আমরা কি এআইয়ের বিপুল সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে পারব? নাকি এআই যখন আমাদের চাকরি কেড়ে নিতে শুরু করবে, তখন আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্রোধান্বিত হয়ে এসব মেশিন ভাঙতে শুরু করবে?

যে শিক্ষার্থীরা এখনো এসব কলেজ বা অন্যান্য কলেজ থেকে ভালো ফলাফল নিয়ে বের হচ্ছে, তাদের এই অর্জন সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টায়। এই সাফল্য প্রতিষ্ঠানের গুণে নয়।

১৯৬৫ সালে যখন সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম, তখন সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা আমার বন্ধুরা ঢাকা কলেজে ভর্তি হয় এবং আমরা যারা দ্বিতীয় সারির ছিলাম, তারা ভর্তি হই নটরডেম কলেজে। জেনারেল আইয়ুব খানের শাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ যখন তীব্র আকার ধারণ করে, বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি ঘোষণার পর আমাদের ঢাকা কলেজের বন্ধুরা আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করে। তাদের অনেকেই তৎকালীন সেরা ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম বামপন্থী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেয়। এমনই ছিল ঢাকা কলেজ।

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

সেই সময়ে ছাত্র রাজনীতির অর্থ ছিল সামাজিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ; একইসঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের জন্য জনমানুষের সংগ্রামের মতো বৃহত্তর বিষয়ে নিজেদের পরিচিত করে তোলা এবং সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও উপনিবেশবাদের প্রভাবের মতো বৈশ্বিক সমস্যার সঙ্গে এগুলোকে সম্পর্কিত করতে শেখা। ফলে, আমাদের মাঝে একধরনের আত্মসচেতনতা গড়ে ওঠে, যা আমাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন করে দিয়ে আরও উন্নত মানুষে পরিণত করে। সহজভাবে বলতে গেলে, ছাত্র রাজনীতি আমাদেরকে দেশ এবং নানা দিক থেকে বিশ্বের আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। আমরা নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি ও বর্ণবাদী সরকারের পতন চেয়ে নিরন্তর স্লোগান দিয়েছি। একইসঙ্গে আমরা ফিলিস্তিন, ভিয়েতনাম, অ্যঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের প্রতিও সমর্থন জানিয়েছি।

আমাদের সময়ে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী অথবা একই কলেজের বিভিন্ন দলের মধ্যে বিবাদ হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেগুলো কখনোই ছাত্র রাজনীতির অংশ ছিল না, যা এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়।

বছরখানেক আগে ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে। ২ দিন ধরে চলা সংঘর্ষে মারা যান ২ জন—নাহিদ মিয়া ও মুরসালিন। অথচ, এই ২ জনের কারোরই এই সংঘর্ষের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

আজকাল ধরেই নেওয়া হয় যে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা সহিংসতায় জড়াবেন, অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন এবং মাস্তানি ও সমাজবিরোধী হিসেবে বিবেচিত অন্যান্য কাজ করবেন। বিপরীতে, সামাজিক দাবি আদায়, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সার্বিকভাবে, ন্যায়বিচারের পক্ষে শিক্ষার্থীদের লড়াই দিনকে দিন বিরল হয়ে যাচ্ছে।

দেশের বেশিরভাগ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র প্রায় এমনই। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল ২০১৮ সালে স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন ও ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, যে দুটো আন্দোলনই এক কথায় অসাধারণ ছিল। তাদেরকে সামাজিক অধিকার আদায়ের কার্যক্রমে আরও যুক্ত হতে উৎসাহ দেওয়ার বদলে সহিংসভাবে দমন করা হয়েছিল। এখনো তাদের অনেকে মামলায় জড়িয়ে রয়েছেন।

ছাত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসেবে একটি প্রশ্ন না তুলে পারছি না—কেন আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছি? অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও দলীয় রাজনীতির অংশ করে ফেলা কি ছাত্রসমাজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দেওয়া নয়? কোনো শিক্ষার্থী যতদিন দলের পেশিশক্তি বাড়াতে চাইবে, ততদিন সে শিক্ষার্থী হিসেবে যাই করুক না কেন, সেটা গ্রহণযোগ্য—এটা কি আমাদের অবস্থান হতে পারে?

আর এর সবই হচ্ছে এমন সময়ে, যখন আমরা মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি—খারাপ দিক হিসেবে জলবায়ু সংকট এবং ভালো দিক হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব, বিশেষত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।

আমাদের ভবিষ্যৎ যাত্রা ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার এর চেয়ে বেশি মর্মান্তিক উদাহরণ আর হতে পারে না। আর এর জন্য পুরোপুরি দায়ী আমরা নিজেরাই। এখানে কোনো 'ষড়যন্ত্র' নেই, রয়েছে শুধু দেশের ভবিষ্যতের প্রতি উদাসীনতা।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments