সংকটের ভেতরেও তিতাস কেন গ্যাসের দাম বাড়াতে চায়?

১. চুলা আছে গ্যাস নেই, রান্নায় ভোগান্তি

২. গাজীপুরে তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে

৩. চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ, খাবার সংকট, দুর্ভোগে মানুষ

৪. চুলায় গ্যাস নেই, তবু মূল্যবৃদ্ধির চেষ্টা

৫. গোপনে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ভাড়া ১০০ টাকা বাড়ালো তিতাস

বেশ কিছুদিন ধরেই এমন সংবাদ শিরোনাম চোখে পড়ছে। রাজধানীর যেসব এলাকায় আগে বিকেলের পরে গ্যাস আসতো, এমন অনেক এলাকার বাসিন্দারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন যে, তারা এখন সন্ধ্যার পরেও গ্যাস পাচ্ছেন না। মিটমিট করে চুলা জ্বলছে। তা দিয়ে রান্না হচ্ছে না। অনেকেই বিকল্প উপায়ে রান্না করছেন অথবা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে খাচ্ছেন।

প্রশ্ন উঠছে, দুই চুলার গ্যাস ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে এক হাজার ৮০ টাকা বিল দেওয়ার পরেও যদি রান্নার জন্য ন্যূনতম গ্যাস পাওয়া না যায়, তাহলে এই বিল নেওয়াটা ন্যায্য কি না? নাগরিকরা এখন যদি 'নো গ্যাস নো বিল' স্লোগান দেওয়া শুরু করেন এবং গ্যাসের বিল না দেন, তাহলে কী হবে?

কী হবে সেটি আন্দাজ করা যায়। যেমন: ঢাকা শহরের ভাড়াটিয়াদের অনেকেরই বাড়ি ভাড়ার সঙ্গে গ্যাস বিল যুক্ত থাকে। ফলে, তারা গ্যাস পেলেন কি পেলেন না, তা নিয়ে বাড়িওয়ালাদের মাথাব্যথা নেই।

দ্বিতীয়ত, বাড়িওয়ালারাও যদি গ্যাসের বিল দেওয়া বন্ধ করে দেন তাহলে হয়তো কর্তৃপক্ষ গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ফলে মালিকরাও গ্যাসের বিল না দেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না।

নাগরিকদের মনে এই প্রশ্নও রয়েছে, যদি গ্যাসের জন্য বিল দেওয়ার পরেও ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় কিংবা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনতে হয়, সেই বাড়তি টাকা কে দেবে? বরং বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংকটের কারণে এখন বৈদ্যুতিক চুলায় রান্না করতে গিয়ে বিদ্যুতেও অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে রেস্টুরেন্টেও চাপ বাড়বে। তাতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের লাভ হলেও পকেট কাটা পড়বে সাধারণ মানুষের।

উপরন্তু পাইপ লাইনে গ্যাস সংকটের কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনছেন এবং তাতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা ক্রমশই বড় হচ্ছে এবং এই খাত নিয়েও মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। সুতরাং পাইপ লাইনের গ্যাস সংকটের পেছনে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবসা সম্প্রসারণের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, অনেকের মনে সেই প্রশ্নও আছে।

বলা হয়, প্রাকৃতিকে কারণে শীতের মৌসুমে গ্যাসের চাপ কমে যায়। ফলে বাসাবাড়ি ও কল-কারখানায় বছরের অন্য সময়ের তুলনায় গ্যাসের চাপ কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। অন্তত সন্ধ্যার পরেও বাসা-বাড়িতে গ্যাস না থাকাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া কঠিন। যদিও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন যে এই সংকট সাময়িক।

এই সংকট কতটা সাময়িক এবং শীতের মৌসুম শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিলে যেমন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয় বা সরকারের তরফেও বলা হয় যে তাপমাত্রা কমে এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে, তেমনি এখন শীতের মৌসুম এলেও গরমের অপেক্ষা করা হয়।

অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রীয় সেবাই নিরবচ্ছিন্ন এবং ভোগান্তিমুক্ত করা যায়নি। এখানে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অনেক কাজও হচ্ছে। কিন্তু সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের আন্তরিকতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ।

অনেক সময়ই মনে হয় নাগরিককে সেবা দেওয়ার চেয়ে তাদের কাছে ব্যবসাটাই বড়। বিশেষ করে গ্যাস খাতে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গত অর্থবছরে (২০২২–২৩) সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ৭০৬ কোটি টাকা। এরপরও তারা মুনাফা করেছে ১৫৮ কোটি টাকা।

অথচ যখন তীব্র গ্যাস সংকটে মানুষ ক্ষুব্ধ; প্রতিদিনই পত্রিকা ও টেলিভিশনে এ নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে—তখন জানা যাচ্ছে, পুনরায় গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করছে তিতাস।

তাদের নতুন প্রস্তাব মানা হলে দুই চুলার গ্যাসের জন্য গ্রাহককে মাসে বিল হবে এক হাজার ৫৯২ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহকরা এখন যে বিল দেন, তারচেয়ে আরও ৫০০ টাকা বেশি গুণতে হবে। অন্যদিকে এখন এক চুলার জন্য মাসে বিল দিতে হয় ৯৯০ টাকা। নতুন প্রস্তাবে এই বিলও ৩৯০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তিতাস।

মূল্যবৃদ্ধির এই প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে কারিগরি কমিটি গঠন করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ কমিটি এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তথ্য–উপাত্ত যাচাইয়ের পর এ মাসের মধ্যেই নিজেদের সিদ্ধান্ত কমিশনকে জানাবে তারা।

প্রশ্ন হলো, জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না দিয়ে বা না দিতে পেরে বিল বাড়ানোর এই প্রস্তাব যে অযৌক্তিক এবং একইসঙ্গে অনৈতিক, সেটি কি তিতাস জানে না?

শুধু মাসিক বিল বাড়ানোর প্রস্তাব নয়, বরং তীব্র গ্যাস সংকটের ভেতরেই তিতাসের প্রিপেইড মিটারের ভাড়াও বেড়েছে। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গোপনে গ্যাসের মিটার ভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে। গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকরা বিল দেন। সেখানে মিটারের ভাড়া কেন দিতে হবে, সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই ছিল।

অথচ নাগরিকের সেই প্রশ্ন আমলে না নিয়ে এতদিন গ্যাসের প্রিপেইড মিটার প্রতি ১০০ টাকা ভাড়া নিতো তিতাস। এবার এক লাফে এটি দ্বিগুণ করা হয়েছে। অথচ গ্রাহকরা এটি জানতেন না। তারা বিল দিতে গিয়ে জানতে পারেন যে মিটার ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের প্রশ্ন, একটি মিটারের দাম কত যে প্রতি মাসে সেটির ভাড়া বাবদ তাদেরকে ২০০ টাকা দিতে হবে?

বাস্তবতা হলো, গ্যাসের বিলের মধ্যেই মিটার চার্জ সমন্বয় করে নেওয়ার কথা। কিন্তু তিতাস আলাদাভাবে মিটার চার্জ নিচ্ছে। এটি নেওয়ার এখতিয়ার তিতাসের আছে কি না এবং গোপনে এই মিটার ভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ করে ফেলার অধিকার তাদের আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।

তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কীভাবে নাগরিকের অসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে, তাদেরকে অবগত না করে, এমনকি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাশ কাটিয়ে গ্যাসের প্রিপেইড মিটারের ভাড়া দ্বিগুণ করলো? তার মানে তিতাস কর্তৃপক্ষ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে আমলেই নিচ্ছে না?

অবশ্য কমিশনকে যাতে আমলে নিতে না হয়, সেই আইন পাস হয়েছে ২০২২ সালেই। ওই বছরের ডিসেম্বরে জারি হয় 'বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন)' অধ্যাদেশ—যেটি জাতীয় সংসদে পাস হয় গত বছরের জানুয়ারিতে।

এই আইন অনুযায়ী, 'বিশেষ পরিস্থিতিতে' জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম সরাসরি বাড়ানো কিংবা কমাতে পারবে সরকার। অর্থাৎ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে কোনো ধরনের শুনানির প্রয়োজন হবে না। তিতাস কি তাহলে এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই কমিশনকে 'পাত্তা না দিয়ে' প্রিপেইড মিটারের ভাড়া দ্বিগুণ করলো?

প্রশ্ন হলো, যদি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানি ছাড়াই সরকার নিজের মতো করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে, তাহলে কমিশনের কাজ কী বা কমিশনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না?

তবে তিতাসের বিরুদ্ধে গোপনে মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ এটি নতুন নয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসেও তারা এই কাণ্ড করেছিল। তখন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে কিছু না জানিয়েই গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত গ্যাসলাইনের জন্য প্রিপেইড মিটার ভাড়া ৪০ টাকা বাড়িয়ে দেয় তারা।

কেন গ্যাস সংকটের ভেতরেও মূল্য বৃদ্ধি করতে চায় সরকার?

অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগে তো নাগরিককে তার কাঙ্ক্ষিত সেবাটি দিতে হবে। যদি ভোক্তারা সময়মতো গ্যাসই না পায়, তাহলে তার কাছ থেকে মাসে মাসে বিল নেওয়াটাই যেখানে অযৌক্তিক ও অন্যায্য—সেখানে নতুন করে কী করে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়? রাষ্ট্রের কাজ কি ব্যবসা করা নাকি নাগরিককে সেবা দেওয়া?

আবার রাষ্ট্রীয় সেবা খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার মানে হলো স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হবে। ভর্তুকি তুলে দেওয়া মানে এখন যাকে মাসে গ্যাস-বিদ্যুতের জন্য আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হয়, তাকে এর দেড় বা দ্বিগুণ পয়সা খরচ করতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়েও মানুষের মনে ক্ষোভের অন্ত নেই। এবার ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজির দাম অনেক। মাছ মাংসের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেলো। এরকম পরিস্থিতিতে গ্যাস বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হলে সেটি নাগরিকের জন্য 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে আসবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম উপার্জনকারী মানুষটির কাছেও নাগরিক সেবাগুলো সর্বনিম্ন মূল্যে পৌঁছে দেওয়া। সুতরাং সেবা খাতে ভর্তুকি কমলে বা সেবা না দিয়ে এর মূল্য বৃদ্ধি করা হলে মানুষের জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।

ভর্তুকি কমালে সচ্ছল ও ধনীদের সমস্যা হয় না। কিন্তু একটি জনবান্ধব রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সবচেয়ে কম আয়ের মানুষটিও যাতে খেয়েপরে ভালো মতো বেঁচে থাকতে পারে—সেটি নিশ্চিত করা। সুতরাং ভর্তুকি কমানোর পক্ষে যতই যুক্তি দেওয়া হোক না কেন—সাধারণ মানুষ তার ভিকটিম হচ্ছে কি না—সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আর যেকোনো সেবার মূল্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরুর আগে দেখতে হবে নাগরিকরা নিরবচ্ছন্নভাবে ওই সেবাটি পাচ্ছে কি না। যদি না পায় তাহলে আগে তার সেবাটি নিশ্চিত করতে হবে। তারপরে কমিশন এবং নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যৌক্তিক হারে মূল্য বাড়াতে হবে।

কিন্তু এ মুহূর্তে গ্যাসের যে পরিস্থিতি, তাতে মূল্য বাড়ানো তো দূরে থাক, নাগরিকদের সময়মতো পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে না পারলে বরং মাসিক বিল এখন কমানো দরকার। কেননা গ্যাস সংকটের কারণে ভোক্তাদের এখন বিকল্প উপায়ে রান্নাসহ দৈনন্দিন অন্যান্য কাজ করতে হচ্ছে। যেখানে তাদের বাড়তি খরচ হচ্ছে। এই বাড়তি খরচ আসবে কোত্থেকে?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

5 Edn institutions: Academic life of 40,000 in disarray

Academic activities in five major educational institutions in Dhaka remain suspended for the past week amid multiple incidents of clashes, affecting at least 40,000 students.

3h ago