রুচির দুর্ভিক্ষ ও বোবা কান্না

মানুষের মধ্যে রুচি কি আছে? যদি থাকত তবে এখন যাদের নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা বা আড্ডা বা তর্কাতর্কি, তা কি থাকত? রুচি তৈরি করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র। এখন প্রশ্ন হলো—শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র কতটুকু ভূমিকা রেখেছে? বা আদৌ রুচি বা মনন তৈরির বিষয়ে তাদের আগ্রহ আছে কি না?

প্রথমেই আসি শিক্ষার বিষয়ে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন কী পড়ছে? তাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো কি কেউ ভালো করে লক্ষ্য করেছেন? না করলেও কোনো সমস্যা নেই। কয়েকটা উদাহরণ দেই।

২০১৭ সালে হেফাজত বর্তমান সরকারকে বলল যে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা সরিয়ে ফেলতে হবে। কী ছিল সেই লেখাগুলোয়? মানুষ তৈরির বীজমন্ত্র। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুদ্ধবোধ তৈরির বিষয়। কেন সরাতে বলা হলো? যাতে শিক্ষার্থীদের মনন যেন সঠিকভাবে তৈরি না হয়।

এর ফলে আসলে হলো কী? এর ফলে ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকা বোর্ডের বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে আমরা দেখলাম সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন। নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন...
চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব ছোটবেলায় পড়েছি। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে ডারউইনের বিবর্তনবাদ যখন পাঠ্যবইয়ে আরও বিস্তৃত করা হলো, তখন শুরু হলো বিতর্ক। এই বিতর্ক এমনভাবে সরকারকে পেয়ে বসল, যারা বিতর্কে যুক্ত হচ্ছেন তারা কিন্তু বিজ্ঞান পড়া লোক নন।

পুরো পৃথিবী চলছে বিজ্ঞান, রোবটিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ দারুণ সব বিষয়ের ওপর। সেই জায়গায় আপনি যখন শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়তে দিবেন না, তখন শিক্ষার্থীদের সেই বিষয় সম্পর্কে ধারণা হবে কীভাবে? শিক্ষার্থীর বোধ তৈরি হবে কীভাবে?

এর ফল আমরা দেখেছি বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রে। তিনি বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে যে পরিমাণ হেনস্তার শিকার হয়েছেন, বিনা কারণে জেল খেটেছেন, তা দেখে অনেক বিজ্ঞান শিক্ষকই এখন ভীত। শুধু বিজ্ঞান নয়, দর্শন, নৃ-তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, সাংবাদিকতা—সব বিষয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারাও এখন ক্লাসে পড়াতে ভয় পান। এই ভয় কি একদিনে জন্মেছে? রাষ্ট্র খুব যত্ন করে ভয় জন্মানোয় সহায়তা করেছে।

শিক্ষার পরেই আসেই সংস্কৃতি। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক হেলেন স্পেনসার-ওটেইয়ের মতে, সংস্কৃতি হলো কিছু বুনিয়াদি অনুমান, মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, নীতিমালা, প্রক্রিয়া ও আচরণিক প্রথার অস্পষ্ট সমষ্টি।

একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের দেশে সংস্কৃতি নিয়ে বিভাজন সবচেয়ে বেশি। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলিম জামাতরা (কাদিয়ানি) কী পালন করবে, কী পালন করবে না, তা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু গত ৩ মার্চ তাদের ওপর যে হামলা হলো, তা সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনার একটি।

৩ মার্চ পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বন্ধের দাবিতে খতমে নবুয়ত ও স্থানীয়রা বিক্ষোভ মিছিল করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১০টি বাড়িঘর ও ৪টি দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ট্রাফিক পুলিশের একটি কার্যালয়। এতে ২ ব্যক্তি নিহত, পুলিশ-সাংবাদিকসহ শতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হন (প্রথম আলো, ২১ মার্চ ২০২৩)।

এর ব্যাখ্যা কী? কেন এমন হলো? কেন এ ধরনের উগ্রতা? শুধু কি ধর্ম? পহেলা বৈশাখ আসলেই শুরু হয় বিষোদগার ছড়ানো। পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত এবং বিভাজনমূলক কথা শোনা যায়। যারা এইসব বিষোদগার ছড়ান, তারা কিন্তু আড়ালে থাকেন না, বরং প্রকাশ্যে এসব বলেন।

শিক্ষা আর সংস্কৃতিতে যখন এই অবস্থা, তখন সমাজ আরও বেশি নীরব ভূমিকা পালন করছে। সমাজ যারা চালিত করেন, তারাও দেখছেন শিক্ষা আর সংস্কৃতিতে যখন আলাদা করে মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না, তখন এই বিষয়ে তারাও কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। তারাও স্রোতে গা ভাসান।

রুচি তৈরিতে প্রতিষ্ঠানের দায় অনেক। আমাদের রুচির বা মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির গুরুত্ব অনেক। প্রশ্ন হলো—রাজধানীর বাইরে এমন কোনো আয়োজন কি দেখছেন যে কর্মকাণ্ড দেখে মনে হবে এই ৩ একাডেমি শিক্ষার্থী থেকে সাধারণ মানুষের রুচি তৈরিতে গণমুখী ভূমিকা রেখেছে? নির্ধারিত ফরমেটের অনুষ্ঠান ছাড়া তারা আর কিছুই করে না। তাতে আর যাই হোক গণমুখী পরিবর্তন আশা করা যায় না।

এর বাইরে আছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। তাদের কার্যক্রমও সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। লতা সমাদ্দারের টিপকাণ্ড, হাইকোর্ট থেকে ভাস্কর্য অপসারণ, বিমানবন্দরের সামনে থেকে লালনের ভাস্কর্য অপসারণ ইস্যুতে একাডেমি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এরপরও আছে সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়। প্রতিবার বিভিন্ন গুজবে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয় নির্দিষ্ট কিছু মানুষের ওপর। যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের কাছে। অথচ তাদের ওপর ৫০ বছরে যে হামলা, নির্যাতন, লুটপাট হয়েছে তার বিচার হয়নি। একাডেমি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনও সজোরে প্রতিবাদে সামিল হয় না। কিছু সংগঠন গা বাঁচিয়ে প্রতিবাদ জানায়। তাও না জানানোর মতোই।

গণমাধ্যমের বিষয়ে কী বলবো, তারা সবচেয়ে বেশি নীরব থাকে সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে। বিশেষ করে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে দেশব্যাপী যে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার প্রতিবাদে গণমাধ্যম শুরু থেকেই ছিল নীরব। এই নীরবতা মূল্যবোধ তৈরি করে না। এই নীরবতা আলাদা করে রুচিসম্পন্ন মানুষ তৈরি করে না। এই নীরবতা হামলাকারীদের বরং উসকে দেয়।

সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের বাইরে সাহিত্যিক বা সচেতন মানুষ সমাজের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমনটা আগে দেখেছি। এখন কি তার দেখা মেলে? সুকুমার রায়ের 'একুশে আইন' কবিতার কথা এখন মনে পড়ছে। কবি লিখেছেন—

"শিব ঠাকুরের আপন দেশে,

আইন কানুন সর্বনেশে!

কেউ যদি যায় পিছ্‌লে প'ড়ে

প্যায়দা এসে পাক্‌ড়ে ধরে,

কাজির কাছে হয় বিচার—

একুশ টাকা দণ্ড তার।।"

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে গোটা ভারত তোলপাড় হয়েছিল। সেই সময় 'নিজেদের মতে নিজেদের গান'টি নজরে এসেছিল। সেই গানে তারা যেভাবে গোটা দেশের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছে, তা আমাদের দেশে অসম্ভব। তারা যেভাবে প্রতিবাদ করেছে, সেই প্রতিবাদের ভাষায় যে শৈল্পিক নিদর্শন ছিল, তা সত্যিই মুগ্ধতা জাগায় মনে।

'আমি গোয়েবলস এর আয়নায়

ঠিক তোমাকেই দেখে ফেলেছি

এই হাঙরের দাঁত পুরনো

তাতে পোঁকা লেগে আছে দেখেছি

তুমি গরীবের ভালো চাও না

সেটা বোঝাতে বাকি রাখোনি

তুমি মিথ্যে পুজোতে ব্যস্ত

কোনো সত্যি লড়াইয়ে থাকোনি'

এই ধরনের কবিতা কোথায়? কেন এখনকার কবি-সাহিত্যিকরা এইভাবে লেখেন না? কেন তাদের কলমে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা আসে না? কেন তাদের কলমে ঝরঝর করে শুধু প্রেমের কথা আসে? কেন?

এবার আসি রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে। ২০ বছরে যে পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, তা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল? ২০ বছরে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, তার বিচারে রাষ্ট্র কী ভূমিকা রেখেছে? সংস্কৃতি নিয়ে উপদ্রবকারীরা যেসব বাজে কথা বলেছে, তা বন্ধে রাষ্ট্র কী করেছে? সততার বুলি আওড়িয়ে অসৎ লোক তৈরির পেছনে রাষ্ট্র কি ভূমিকা রাখেনি? পোশাকের নামে যারা কটূক্তি ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কিছু করেছে? শিক্ষাকে যেভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য রাষ্ট্র কী করেছে? এর উত্তর যদি মেলে, তাহলে বুঝব রাষ্ট্র সত্যিই রুচির দুর্ভিক্ষ কমাতে কোনো ভূমিকা রেখেছে।

তবে কি নাট্যজন মামুনুর রশীদ যথার্থ বলেননি? তিনি বলেছেন—'আমাদের রাষ্ট্র তো কোনোভাবে রুচির উন্নয়নে কাজ করছে না। তাই এখন আমার আর রাজনীতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সংস্কৃতির কাছে, কোথাও আবেদন-নিবেদন নেই।' (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০২৩)

তবে কি শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থ বলেননি? তিনি বলেছেন—'মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল টাকাই আসেনি, মৌলবাদের চর্চায় উৎসাহও এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি; তার বিপরীতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য ঘটেছে। ...পাড়ায়-মহল্লায় সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। এমনকি খেলাধুলার জায়গাও কমে গেছে। অপর দিকে ওয়াজের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার প্রচারকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাস্যকৌতুক বেশ দুর্লভ হয়ে পড়েছে।'

রুচির দুর্ভিক্ষে আমরা আরও আগেই পড়েছি। এখন তা প্রকটরূপে দৃশ্যমান হচ্ছে। এখন আমাদের অসহ্য লাগছে।

'তোমার কোনো কোনো কোনো কোনো

কোনো কোনো কোনো কথা শুনবো না আর

যথেষ্ট বুঝি কিসে ভালো হবে

নিজেদের মতো ভাববো'

এভাবে যেদিন আমরা বলতে পারব, সেদিন আমাদের রুচি ফিরবে।

বিনয় দত্ত: কথাসাহিতিক ও সাংবাদিক

benoydutta.writer@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments