আকবর আলি খান: জনযুক্তিবাদী ভূমিপুত্রের বিদায়

আকবর আলি খান ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন অর্থনীতিতে। চাকরিসূত্রে কাজ করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সরকারি চাকরিবিধির শুরু থেকে শেষের সব পাঠ নিয়েছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। রাষ্ট্র-প্রশাসন-সমাজ, দেশ ও জনগণকে বুঝেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই অর্থে বলা যায় এখানে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী।
আকবর আলি খান। স্টার ফাইল ফটো

আকবর আলি খান ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন অর্থনীতিতে। চাকরিসূত্রে কাজ করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সরকারি চাকরিবিধির শুরু থেকে শেষের সব পাঠ নিয়েছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। রাষ্ট্র-প্রশাসন-সমাজ, দেশ ও জনগণকে বুঝেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই অর্থে বলা যায় এখানে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী।

কিশোর বয়স থেকেই আকবর আলি খান হয়ে ওঠেন বইপড়ুয়া। মা, পরিবার ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় বই সংগ্রহ করতেন দূরের লাইব্রেরি থেকে, কিনতেনও। সে সময় সাহিত্য ছিল তার আগ্রহের কেন্দ্রে। একজন ব্যক্তির এভাবে নানান পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা যাকে খুঁজে পাই, তিনি হলেন লেখক-গবেষক-সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তক আকবর আলি খান।

একজন ব্যক্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন, দেশ ও জাতির দিশা হয়ে দেখা দেন, তার অনন্য এক উদাহরণ আকবর আলি খান। বিরলপ্রজ শব্দের অতি ব্যবহারে, আক্ষরিক অর্থে এর আবেদন-ওজস্বিতা ও ঐশ্বর্য নেই বললেই চলে। সদর্থক অর্থেই এই শব্দের প্রয়োগ তাকেই মানায় কেবল।

বিরলপ্রজ এই ব্যক্তিত্বের সব কাজের বৈশিষ্ট্য হলো তিনি যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন। লেখালেখি ও বয়ানে সবিশেষ এই গুণপনার সঙ্গে ছিল তার স্পষ্টবাদিতা। সহজাতভাবেই ছিলেন ভীষণ রকমের অধ্যবসায়-গবেষণানিষ্ঠ এবং এই গুণই তাকে পরিচিতি দিয়েছিল স্পষ্টবাদী এক বক্তারূপে। যা বিশ্বাস করতেন, যাতে আস্থা রাখত তার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা-এষণা প্রাপ্ত উপাদান ও অনুষঙ্গ, তাই-ই বলতেন অনায়াসে। এসবের মধ্যে দিয়ে আমরা খুঁজে পাই একজন জনযুক্তিবাদী চিন্তককে, একজন জনবাদী স্পষ্ট বক্তাকে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ একজন ভূমিপুত্রকে।

যখন সত্য প্রকাশে অনেকেই দ্বিধান্বিত ও নানা সমীকরণে ব্যতিব্যস্ত, তখন আকবর আলি খান ছিলেন কুণ্ঠাহীন-সত্যবাদী একজন যুধিষ্ঠির। যিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে, চিরপ্রয়াণের পথে পাড়ি দিলেন ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। মারা যাওয়ার ঠিক ১ সপ্তাহ আগে প্রধান আলোচক হিসেবে হাজির হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের বই 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' নিয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হয়েছেন তার বক্তব্যে। আশি ছুঁইছুঁই বয়সে তিনি যেভাবে লিখিত আলোচনা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর যেরকম নোট দিয়েছেন। বইয়ে উল্লিখিত বিষয়কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছেন এবং বর্তমান সময়ে সেসবের প্রাসঙ্গিকতা কী রূপে, কীভাবে, কত প্রকারে আছে, তা দেখিয়েছেন। এককথায় ব্যাপারটা যতটা বিস্ময়ের, ততটাই প্রশংসার।

আবুল মনসুর আহমদ এই বই লিখেছিলেন যাতে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আসে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা বিরাজিত থাকে। আলী আকবর খানের এষণা হলো, গণতন্ত্র না থাকলে এসবের কোনোটাই বাস্তবায়িত হবে না। তিনি মনে করেন, কেবল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব। ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বাস্তবায়ন জরুরি। তিনি মনে করতেন সমাজতন্ত্র অর্থ কেবল মার্কস, লেনিনের সমাজতন্ত্র নয়, স্থানীয়ভাবেই সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব।

আকবর আলি খান সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলেও লেখালেখিকেই তিনি সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি সত্যিকারার্থে যাপন করতেন লেখক জীবন। প্রায় ১ দশক ধরে শারীরিকভাবে জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। স্ত্রী ও ১ মাত্র সন্তানের চির বিদায়ের পর লেখালেখির মধ্যে নিজের দুঃখ-কষ্ট-বেদনার উপশম খুঁজে ফিরতেন কিংবা সবাইকে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। তার কন্যা নাহিন খানের ইচ্ছা ছিল বাবা যেন সবিস্তারে লেখে পূর্ব পুরুষের ঠিকুজি। কন্যা মারা যাওয়ার পরও তিনি তার সেই ইচ্ছার কথা বিস্মৃত করেননি। লিখেছেন আত্মস্মৃতিমূলক বই 'পুরানো সেই দিনের কথা'।

কন্যার প্রতি একজন পিতার অপত্য স্নেহ যেমন কখনো শেষ হওয়ার নয়, আকবর আলি খানেরও সেটা হয়নি। বরং তিনি যেমন কন্যাস্নেহের দায়বদ্ধতা পালন করেছেন, তেমনি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন সর্বক্ষণে। জনগণের প্রতি এই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি দেশপ্রেমের দায় মিটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন দেশকে ভালোবেসে। পাকিস্তান সরকারের একজন চাকরিজীবী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একেবারে শুরুর দিকের একজন। একজীবনে যতটা ঝুঁকি নেওয়া যায়, ঠিক ততটাই নিয়েছেন। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে ট্রাকে করে ৩ কোটি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে। এসবের কারণে তার অনুপস্থিতিতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। তিনি মনে করতেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়া।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা পেশা ছাড়াও জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন সরকারি চাকরিতে, থেকেছেন বিভিন্ন পদে নানান জায়গায়। সেসময় ন্যায়নিষ্ঠা ও সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজের ভাবমূর্তি। যার সুবাদে ও কল্যাণে অলঙ্কৃত করেছেন সরকারি চাকরিবিধির সর্বোচ্চ পদ। হয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, যদিও ন্যায্যতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ ও পরিবেশ না পাওয়ায় আরও ৩ জন উপদেষ্টার সঙ্গে ইস্তফা দেন এই পদ থেকে। এসব পরিচয়কে ছাড়িয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। যার আয়ুষ্কাল সহসা হারিয়ে যাওয়ার নয়, চাইলেই বিস্মৃত হওয়ার নয়। এখানেই নিহিত আছে একজন আকবর আলি খানের জীবনের সাফল্য ও সার্থকতা।

যতদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন আকবর আলি খানের গবেষণানিষ্ঠ কাজগুলো তাকে অমরত্ব দেবে, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় করে রাখবে। কারণ তিনি আমাদের জাতিসত্তার অন্বেষণে ব্রতী ছিলেন। 'বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা', 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ' বইয়ের ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের শেকড়ে নতুন আলো খোঁজার চেষ্টা করেছেন। নতুন চিন্তাকে হাজির করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে রিচার্ড ইটন, অসীম রায়ের গবেষণার বাইরেও তার ভাবনা নতুন আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে। শুধু এই বইগুলোতে নয়, আকবর আলি খানের বইয়ের বিশেষত্ব হলো সেখানে বহুমাত্রিক অর্থ অনুসন্ধানের চেষ্টা থাকে। তিনি যেহেতু ইতিহাস-অর্থনীতি-সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সাহিত্যের শিক্ষার্থী-অনুরাগী ও অভিজ্ঞতালব্ধ ছিলেন, সেহেতু তার সব লেখালেখিতে বহুধা বিস্তৃত জ্ঞানান্বেষণের প্রয়াস ও প্রচেষ্টা ছিল উদ্দিষ্ট প্রসঙ্গের ভরকেন্দ্র স্বরূপ। একারণে তার অভিনিবেশ, অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত ও মতামতের সঙ্গে অমিল হলেও তাকে উপেক্ষা কিংবা খারিজ করা সম্ভব নয়। এখানেই তার যুক্তিবাদী সত্তার সার্থকতা।

আকবর আলি খানের যুক্তিবাদিতার প্রধান লক্ষ্য ও ঝোঁক ছিল 'জন' মনস্তত্ত্বকে আবিষ্কার করা। সেই প্রবণতা যেমন দেখা যায় তার অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র, জাতিসত্তা বিষয়ক গবেষণায়, তেমনি দেখা যায় তার রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ বিষয়ক অনুসন্ধানেও।

জীবনানন্দ দাশের বহুল আলোচিত কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র বনলতা সেনকে নিয়ে যে বয়ান তিনি হাজির করেছেন, তা নিঃসন্দেহে কৌতূহলের ও আগ্রহোদ্দীপক। বনলতা সেন সম্পর্কে যে অনুসন্ধান তিনি দিয়েছেন, তা পূর্বের সব পাঠ থেকে একেবারেই ভিন্নার্থের। তিনি নানা যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে বলেছেন নাটোরের বনলতা সেন আসলে একজন রূপোপজীবিনী। এই অন্বেষণের সবিশেষ গুরুত্ব হলো কারও পছন্দ-অপছন্দের চেয়েও এখানে যেসব যুক্তি-তর্ক হাজির করা হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে কত বিষয়কে যুক্ত করা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা 'চাবিকাঠির খোঁজে' সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। যদিও জীবনানন্দ দাশ তার প্রবন্ধে কবিতার চরিত্র সম্বন্ধে সুলুকসন্ধানী ধারণা দিয়েছেন এবং প্রচলিত ও আক্ষরিক অর্থে তার সৃষ্ট চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছেন।

আকবর আলি খান অর্থনীতিতে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যুক্ত করেছেন, যা যতটা প্রশংসিত ঠিক ততটা আলোচিতও। 'শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি', 'সুকতলার অর্থনীতি', 'জুতার রাজনীতি', 'জন্মদিনের অর্থনীতি' প্রভৃতি। এসব বিষয় যে একেবারে আনকোরা, তা নয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়েই 'শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি'র বিষয়টা সেই সময়ের প্রশাসনে আলোচিত ছিল। আকবর আলি খান স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় নতুন করে এসবের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

'প্রহেলিকা' শব্দটা আকবর আলি খান ব্যবহার করেছেন 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ' বইয়ে। সুলুকসন্ধানের বিষয় হলো, এই শব্দের প্রয়োগ করে তিনি চমৎকারভাবে সেসব খোলতাই করার চেষ্টাও করেছেন। আকবর আলি খানের বেশিরভাগ লেখালেখি ও গবেষণা যেহেতু 'টেক্সট টু টেক্সট', এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এসবের ব্যাখ্যা তিনি এমনভাবে করেছেন, যাতে পাঠক-গবেষকেরা নতুন চিন্তার খোরাক পান। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রতিই তার অভিনিবেশ সীমায়িত করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার সিদ্ধান্তে যাননি। এমনকি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও টেক্সটের কাছেই থেকেছেন সমর্পিত। কখনোই টেক্সটের বাইরে গিয়ে নিজস্ব দর্শন-অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করার চেষ্টা করেননি। কেন করেননি, তার বিদায়ের মধ্যে দিয়ে বিষয়টা আমাদের কাছে 'প্রহেলিকা'র মতোই রয়ে গেল।

যুক্তিবাদ যখন শৃঙ্খলিত এবং চোখ রাঙানোতে শাপ ও শঙ্কাগ্রস্ত, তখন একজন আকবর আলি খানের যুক্তিবাদিতা আমাদের দিশা দেখায়। এই যুক্তিবাদিতার সঙ্গে যখন 'জন' যুক্ত হয় কিংবা অনিবার্যরূপে হাজির থাকে, তখন দেশ-জাতিও আশান্বিত হয়। তার চির বিদায়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের সেই দিশা দেখার সাহস ও আশান্বিত হওয়ার মন্ত্র ফিকে হয়ে গেল। এখন তার বইগুলো আমাদের অনুপ্রেরণার শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে যদি সেসব থেকে দীক্ষা নিই।

একজন পেশাদার আমলা ছাড়াও আকবর আলি খান আমলার জীবনের শুরু ও শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্রের তকমা পেয়েছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। পিএইচডি করেছেন কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব উল্লেখ করার কারণ হলো একজন প্রথাগত আমলা ও অ্যাকাডেমিশিয়ান হয়েও তিনি এসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। একজন আমলাও যে কীর্তিমান হতে পারেন, তার শিক্ষা নিতে পারেন এসময়ের আমলারা আকবর আলি খানের জীবন ও কর্মের আলোকে। আবার একজন অ্যাকাডেমিশিয়ানও যে প্রথাগত গবেষণার বাইরে গিয়ে নতুন প্রশ্ন, নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হাজির করতে পারেন, নতুন চিন্তা উৎপাদন করতে পারেন, তার শিক্ষা নিতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। যুক্তিবাদিতা যদি ধ্যানজ্ঞান হয় এবং এর সঙ্গে জন'র স্বার্থকে দেওয়া হয় প্রাধান্য, তাহলে সব সময় সব পরিস্থিতিতে যুক্তিগ্রাহ্য ও স্পষ্ট কথা কীভাবে বলতে হয়, তার সবক নিতে পারেন আমাদের লেখক-কবি-সাংবাদিক-সুশীল সমাজ এমনকি রাজনীতিবিদরাও।

আকবর আলি খান জীবনভর আলোর সন্ধান করেছেন, এই সন্ধান ব্যক্তির জন্য নয়, দেশ-জাতির জন্য। তার একটি বইয়ের উপশিরোনামে 'আলোক সন্ধান' শব্দবন্ধ রয়েছে। এতেও অনুমিত হয় একজীবনে তার ব্রত ছিল আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠা, বাস্তবে তিনি সেটাই হয়েছেন।

আলোর ফেরিওয়ালা আকবর আলি খানের লক্ষ্য ছিল সমাজকে আলোকিত করা। সেই আলোর জন্য তিনি হেঁটেছেন ইতিহাসের পথে। বাংলার সমাজকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন-জানতে চেয়েছেন আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সামাজিক পুঁজির তত্ত্বকেও তার গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। যেখানে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় হাত দেননি, সেখানেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তার যৌক্তিকতাও উপস্থাপন করেছেন। সামাজিক পূঁজির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পাকিস্তান, ভারতের চেয়ে কম নয় শুধু, গড় সামাজিক পুঁজির পরিমাণেও আমরা পিছিয়ে। আমাদের সমাজের এই প্রবণতা কেন এবং কবে থেকে তা রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

বাংলাদেশের সমাজ ও প্রাচীন বাংলার সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রকাশটা বেশি। যেটা পশ্চিমবঙ্গেও এভাবে নেই, ভারতের অন্যত্রও নেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও নেই। আকবর আলি খান মনে করেন আমাদের সমাজ রাষ্ট্রকে বুঝতে হলে এবং আমাদের জাতিসত্তার প্রশ্নে ফায়সালা করতে হলে সমাজের এসব বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানতে হবে। তিনি গ্রামের গড়ন নিয়েও অনুসন্ধানী ছিলেন। সমাজের মতো গ্রামের গড়নের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা লক্ষণীয়। যে ভিন্নতা ব্যক্তিতে-সমাজে-গ্রামের গড়নে, প্রকৃতার্থে সেসবের মধ্যেই বাঙালির শেকড় ও ইতিহাসের সুলুকসন্ধান রয়েছে বলে তার অনুসন্ধান বলবত রেখেছিলেন।

আকবর আলি খানের অনন্যতা ও স্বতান্ত্রিকতা হলো তিনি যেমন ইতিহাসের ধূসর পথে একজন পরিব্রাজক-গবেষকের মতো নিরলস অনুসন্ধানী ছিলেন, তেমনি সমাজ-রাষ্ট্রের বর্তমানের সংকট ও সম্ভাবনার দাবি ও দায় মেটাতেও অবিচল ও কুণ্ঠাহীন ছিলেন। দেশ ও জাতির যেকোনো প্রয়োজনে তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। ক্ষুরধার যুক্তি ও জ্ঞানের অভিনিবেশে তিনি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছেন, যা শুধু ব্যতিক্রম নয়, তুলনারহিত। মেধা, মনন, যুক্তিবাদিতা ও সাহসের সম্মিলনে আকবর আলি খান ছিলেন তার সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন ভূমিপুত্র।

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

kazal123rashid@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

World Bank to provide $300m for clean air project: Rizwana

This initiative aims to strengthen air quality management and reduce emissions from key sectors

50m ago