আত্মজীবনীতে কিছুটা হিপোক্রেসি থাকে, আমি তা করিনি
চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রথমা থেকে প্রকাশ হয়েছে আকবর আলি খানের আত্মজীবনী 'পুরানো সেই দিনের কথা'। এখানে তার বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের জীবনের উন্মেষ ও বিকাশের কথা উঠে এসেছে। তিনি নতুন বই নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: 'পুরানো সেই দিনের কথা' কতদিন ধরে লিখছেন?
আকবর আলি খান: আমি এটা গত এক বছর ধরে লিখছি। অনুলিখনে ছিলেন শহিদুল ইসলাম নামে একজন। তাকে প্রথমা প্রকাশন থেকে দেওয়া হয়েছিল। তাদের পরিকল্পনা, আমার সঙ্গে সমন্বয় করে বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে বইটি।
বইতে আপনার জীবনের অনেক কিছু উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময়ের তথ্যগুলো কি আগে থেকে নোট রেখেছিলেন?
আকবর আলি খান: না, কোন নোট রাখিনি। লেখার সময় আমি এগুলো নিয়ে গবেষণা করেছি। যারা আমাকে জানেন তাদের প্রশ্ন করেছি। তারা যে তথ্য দিয়েছে আর আমি যে তথ্য জানতাম সেগুলো সঙ্গে মিলিয়ে তারপর সমন্বয় করার চেষ্টা করেছি। সেভাবেই 'পুরানো সেই দিনের কথা' লিখেছি।
অনেক আগের তারিখ, সাল ব্যবহার করেছেন। সেগুলো কীভাবে যাচাই করেছিলেন?
আকবর আলি খান: পুরনো তারিখগুলো অন্যান্যদের আত্মজীবনী, পত্রিকা থেকে নিয়েছি। বাকি কিছু তারিখ আছে যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের বইপত্র থেকে নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল দিনগুলো স্পষ্ট মনে আছে। অসহযোগ আন্দোলনের কথা লিখেছি। আর আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব নির্ভুল করার জন্য। তারপরেও হয়তো কিছু ভুল হতে পারে, কেউ ধরিয়ে দিলে সেটা বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে পরিমার্জন করে দেব।
অনেকে আত্মজীবনীতে তথ্য আড়াল করেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন
আকবর আলি খান: আমার মনে হয় আমি অকপটে যা বলার বলেছি কিন্তু তবুও লোকের মনে প্রশ্ন হতে পারে আড়াল কতটা করেছি। কেউ বলবে, আমি আত্মপ্রচারের জন্য কিছু বলেছি। এটাই আত্মজীবনীর বড় সমস্যা। আত্মজীবনী লিখলে লোকে সন্দেহ করে- মনে মনে বলে বোধহয় আত্মপ্রচারের জন্য লিখেছে। এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আত্মজীবনীতে কিছুটা হিপোক্রেসিও থাকে। আমি তা করিনি, এখন লোকে যদি পড়ে আনন্দ পায়, সেটাই সার্থকতা।
এখানে কত সাল থেকে কত পর্যন্ত আপনি বর্ণনা করেছেন?
আকবর আলি খান: 'পুরানো সেই দিনের কথা' বইতে ১৫টি অধ্যায় আছে। এতে আমার মা বাবার কথা ছাড়াও পারিবারিক ঠিকুজি, বংশ পরম্পরা আছে। বিশেষ করে আমার জীবনের ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বর্ণনা আছে। কেবলমাত্র এই আত্মজীবনী পড়ে আমার ও বাংলাদেশের গতিপথ বোঝা যাবে না। পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী পর্ব শুরু হবে ১৯৭৩ সাল থেকে। যা হবে 'পুরানো সেই দিনের কথা'র দ্বিতীয় খণ্ড।
আপনার পড়া সার্থক আত্মজীবনী কাদের?
আকবর আলি খান: কামরুদ্দীন আহমেদের দুই খণ্ডে বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ আমার ভালো লেগেছে। যিনি একাধারে আইনজীবী, রাজনৈতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক ছিলেন। সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক আবুল মনসুর আহমেদের আত্মকথা, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' পড়েছি। পড়েছি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মজীবনী 'ইন্ডিয়া উইংস ফ্রিডম'। তিনি তরুণ বয়সেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান।
এগুলোতে অনেক তথ্য আছে, উঠে এসেছে সামাজিক ইতিহাস। যা আমার লেখার ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে এই মাসে। সামাজিক মুক্তির ক্ষেত্রে কতটা অগ্রসর হয়েছি বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান: সামাজিক মুক্তি নিয়ে আমি দ্বিতীয় খণ্ডে লিখব। এ নিয়ে আমি আরও চিন্তা করতে চাই। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। একটা জাতির স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু নাই। অর্থনৈতিক অগ্রগতিও আমাদের হয়েছে। আমরা তো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। গণতন্ত্র এখনো যদিও বাংলাদেশের সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুশাসন হয়নি। যেখানে আইনের শাসনও সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। সেখানে অনেক কিছু ভাবার আছে, দেখার আছে।
এই প্রজন্ম বই পড়ার সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কি?
আকবর আলি খান: প্রজন্ম, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি করবে বলা মুশকিল। কারণ ইলেকট্রনিক বিপ্লবের পরে বই লোকে কিনবে কিনা সন্দেহ জাগে। আমি ১৭-১৮টি বই লিখেছি। যতদূর দেখেছি পাঠকরা মোটামুটি সেই বইগুলো কিনেছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এখনো বই থেকে মানুষ দূরে সরে যায়নি। তবে ভবিষ্যতে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নতির সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধের সংকটও আছে। আপনিও তাই মনে করেন?
আকবর আলি খান: হ্যাঁ। অবশ্য সংস্কৃতি আমাদের মূল্যবোধের সংকট উত্তরণের সহায়তা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নতির সঙ্গে মূল্যবোধের সঙ্কট চলমান। তবে সাংস্কৃতিক যে উদ্দীপন সেটা অনেক হয়েছে তবে আমাদেরকে আরও অর্জন করতে হবে বলে আমি মনে করি।
এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা কতটা?
আকবর আলি খান: এক্ষেত্রে কোনো কোনো সংবাদপত্র কাজ করছে। কোনো কোনো সংবাদপত্র তো আসলে সংবাদপত্রই না, বাণিজ্যিক প্রচারের উপকরণ মাত্র। তবে কোনো কোনো সংবাদপত্র আসলেই অনেক দুঃসাহসিক কাজ করছে। ভূমিকা রাখছে এগিয়ে যেতে।
Comments