আকবর আলি খানের চোখে জীবনানন্দ দাশের কবিতা
কোনরকম ঝুঁকি ছাড়াই বলা যাইতে পারে যে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আকবর আলি খানের তেমন কোনো জনপরিচিতি ছিল না। তিনি কঠিন টাইপের বাংলাদেশ সরকারের সচিব ছিলেন, এতটাই নিরাবেগ ও রাশভারী যে এমনকি সহকর্মীদের কাছেও ভীতিকর। ঢাকা নগরীর জনপরিসরে তাহার উপস্থিতি ছিল শূন্য। তিনি একাধারে ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ─ এই পরিচয় সর্বজনবিদিত ছিল না। পরবর্তী দুই যুগে তিনি একজন জননন্দিত বুদ্ধিজীবী হইয়া উঠেন।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হইতে পদত্যাগ করিবার পর তাহার সম্পর্কে জনতার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হইল। এই কৌতূহল ক্রমে বাড়িয়াছে। তিনি নানাবিধ বিষয়ে লেখালিখি করিয়া এবং গণমাধ্যমে সাহসী বক্তব্য রাখিয়া সহসা জনমানুষের নৈকট্য অর্জন করেন। ২০১০ সালে একদিন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বক্তৃতা দিবার সময় যখন বললেন, বনলতা সেন মুখ্যত নাটোরের পতিতালয়ের একজন বাসিন্দা ছিলেন, তখন জানা গেল তিনি কেবল জীবনানন্দ দাশের কবিতার অনুরাগী পাঠকই নহেন, জীবনানন্দের কবিতা লইয়া তাহার মনে গভীর ভাবনা বিরাজমান রহিয়াছে। গবেষকের অনুসন্ধিৎসা লইয়া তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিরীক্ষা করিয়া থাকেন।
প্রদত্ত বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা গেল তাহার ২০১১ সালে প্রকাশিত ''অন্ধকারের উৎস হতে'' গ্রন্থের সাহিত্যপর্ব অংশে। সাহিত্যপর্বের শিরোনাম 'অন্ধকারের উৎস হতে : নতুন আলোকে বনলতা সেন'। ভূমিকায় লিখিয়াছেন: ইহাতে তিনি বাংলা সাহিত্যের 'মোনালিসা' বনলতা সেনর স্বরূপ উদ্ঘাটন করিয়াছেন। তিনি আরও লিখিয়াছেন, অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের মন্তব্য আমাকে উৎসাহিত করিয়াছিল─ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে তিনি অন্ধকারের উৎস হইতে উৎসারিত বিবেচনা করিয়াছেন। এই প্রতীতিতে তিনি গ্রন্থটির প্রচ্ছদনাম নির্বাচন করিয়াছেন "অন্ধকারের উৎস হতে"। বনলতা সেন, যিনি এতকাল ছিলেন একজন রহস্যাবৃত নারী, আকবর আলি খানের ব্যাখ্যার সূত্রে প্রহেলিকাময় হইয়া উঠিলেন।
আকবর আলি খান কেবল বনলতা সেনের স্বরূপ লইয়া চিন্তিত ছিলেন তাহা নহে, তিনি 'বনলতা সেন' নামীয় বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতাটিতে ইংরেজি কবিতার প্রভাব লইয়া ভাবিয়াছেন। কবিতাটির অনুবাদের সমস্যাও তাহাকে আকুল করিয়াছে। মূল কবিতার সহিত স্বয়ং কবিকৃত অনুবাদের বিভেদ তাহাকে উদভ্রান্ত করিয়া ছাড়িয়াছে। অধিকন্তু, তিনি জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন কবিতায় চিত্রিত 'বনলতাদের' তুলনা করিয়াছেন। কবিতাগুলি হইল একটি 'পুরনো কবিতা', 'হাজার বছর ধরে খেলা করে' এবং 'শেষ হলো জীবনের সব লেনদেন'। শেষতঃ 'বাঙ্গালী পাঞ্জাবী মারাঠি' কবিতাতে বনলতার উপস্থিতির প্রতি তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। অনুমান করা যাইতে পারে যে ২০০৬ সালে দেশী ও বিদেশী আমলাতন্ত্র হইতে সম্পূর্ণ অবসরগ্রহণের পর তিনি একজন পাঁড় সমালোচকের দৃষ্টি লইয়া জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়িতে শুরু করিয়াছিলেন। এই পঠন-পাঠনের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশ করিলেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা লইয়া পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ যাহার নাম ''চাবিকাঠির খোঁজে''। গ্রন্থটির উপশিরোনাম 'নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন'।
২.
খান সাহেব তিনটি পর্বে বইয়ের বিষয়বস্তু বিন্যস্ত করিয়াছেন। প্রথম পর্ব হইল 'পটভূমি': এই অংশে তিনি ব্যক্তি জীবনানন্দ ও সমকালীন পরিবেশের উপর আলোকপাত করিয়াছেন। এই অংশে তিনি জীবনানন্দের জীবনের গৎবাঁধা ব্যাখ্যা ও বাস্তবতার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। অতঃপর কবির কাব্যের ভৌগলিক, সামাজিক ও নৈতিক পরিবেশের উপর আলোকপাত করিয়াছেন। এই অংশের সর্বশেষে তিনি কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ''বনলতা সেন''-এর রচনাকাল, সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি ঐতিহাসিক বিষয় স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন।
গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের শিরোনাম 'কবিতার নিবিড় বিশ্লেষণ'। এই অংশে ''বনলতা সেন'' কাব্যগ্রন্থের সবগুলি কবিতা লইয়া নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করিয়াছেন। ''বনলতা সেন'' লইয়া এরকম অন্য আরও একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া আমাদের জানা নাই।
গ্রন্থের তৃতীয় ও শেষ পর্বের শিরোনাম 'সামগ্রিক বিশ্লেষণ' যাহার প্রধান উপজীব্য হইল ''বনলতা সেন'' কাব্যের কবিতাসমূহের প্রকৃতি ও বিষয়বস্তু এবং এই কাব্যে প্রতিফলিত দর্শন। শেষোক্ত অংশের দুইটি বিষয় হইল জীবনানন্দের কবিতায় বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব ও দ্বৈতবাদ।
''বনলতা সেন'' কাব্যগ্রন্থটির কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাস রহিয়াছে। ১৯৩৪ সালে কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর উদ্যোগে জীবনানন্দ দাশ প্রথম ''বনলতা সেন'' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহাতে কবিতার সংখ্যা ছিল ১২। কবির জীবদ্দশায় ''বনলতা সেন"-এর বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত (১৯৫২) হইয়াছিল যাহাতে কবিতার সংখ্যা ছিল ৩০। এই কবিতাগুলোকে জীবনানন্দ বিষয়ক আলোচনার উপজীব্য করিয়াছেন আকবর আলি খান।
অভিজ্ঞ পাঠক সহসা ধরিতে পারিবেন ৩০টি কবিতার মধ্যে অনেকগুলি ''মহাপৃথিবী'' কাব্যগ্রন্থ হইতে পরিগৃহীত। কবির চতুর্থ কাব্যসংকলন ''মহাপৃথিবী'' প্রকাশিত হইয়াছিল ১৯৪৮ সালে । সুতরাং দেখা যাইতেছে, বনলতা সেনের কবিতাগুলি অনেকাংশে মহাপৃথিবী'রও কবিতা বটে। ১৯৪৮ সাল নাগাদ জীবনানন্দ অন্যূন দুই সহস্রাধিক কবিতা রচনা করিয়াছেন। তবু বনলতা সেন-এর কলেবর বৃদ্ধি করিতে চতুর্থ কাব্যসংকলন হইতে দেনা করিতে হইল? ─ এই রহস্যের ভেদ আর হইবার নহে। মহাপৃথিবী'র কবিতাগুলির মধ্যে ছিল 'হাওয়ার রাত', 'হায় চিল', 'ঘাস', 'বেড়াল', 'হাজার বছর ধরে খেলা করে' ইত্যাদি। 'বেড়াল' কবিতাটির শিরোনাম বিভিন্ন সংকলনে বিড়াল বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
৩.
আলোচনাধীন গ্রন্থে আকবর আলি খান কখনও দীর্ঘ পরিসর লইয়া একটি কবিতার ব্যবচ্ছেদ করিয়াছেন, কখনো তাহার ব্যবচ্ছেদ সংক্ষিপ্ত। সবচেয়ে দীর্ঘ আলোচনা 'বনলতা সেন' কবিতাটি লইয়া। 'হরিণেরা', 'শ্যামলী', 'অবশেষ', 'স্বপ্নের ধ্বনিরা', 'ধান কাটা হয়ে গেছে' 'হাজার বছর শুধু খেলা করে', 'মিতভাষণ' ইত্যাদি লইয়া আলোচনা সংক্ষিপ্ত।
কবিতা ধরিয়া ধরিয়া আলোচনার ক্ষেত্রে খান সাহেব একটি স্ব-নির্বাচিত কাঠামো ব্যবহার করিয়াছেন। প্রথমে পুরা কবিতাটি উদ্ধারণ করিয়াছেন; তারপর উল্লেখ করিয়াছেন কবিতটির রচনা ও প্রকাশকাল সম্পর্কীয় প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলী। অতঃপর রহিয়াছে কবিতার অন্তর্ভুক্ত কোন শব্দ, শব্দাবলী বা বাক্যাংশ লইয়া ধোঁয়াশা থাকিলে টিকা-ভাষ্য সহযোগে স্পষ্টীকরণের চেষ্টা। চতুর্থত: তিনি সেই চাবিকাঠির কথা উল্লেখ করিয়াছেন যাহা দিয়া কবিতাটিকে সম্পূর্ণ অনুধাবন করা সম্ভব। সর্বশেষে তিনি কবিতাটির সামগ্রিক তাৎপর্যের উপর আলোকপাত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। একটি উদাহরণ-
'স্বপ্নের ধ্বনিরা' কবিতার রচনাকাল সম্পর্কে লেখা হইয়াছে: এ কবিতাটি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ''কবিতা'' পত্রিকায় পৌষ ১৩১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর দুই বছর আগে 'বনলতা সেন' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। 'আট বছর আগে একদিন' কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৩৩৬ সালে। 'স্বপ্নের ধ্বনিরা' কবিতার চাবিকাঠি সম্পর্কে লিখিয়াছেন: এই কবিতায় কোন চাবিকাঠি নেই। তবে স্বপ্নের বার্তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বপ্নের বার্তা পরাবাস্তব কবিতার একটি লক্ষণ।
'স্বপ্নের ধ্বনিরা' কবিতার সামগ্রিক তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলিয়াছেন: কবি স্বপ্নে বার্তা পেয়েছেন: স্থবিরতা সবচেয়ে ভালো। যারা স্থবির তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি সুসংবাদ। কবিও স্থবির হইতে চান। তিনি অন্ধকারে ঠেস দিয়ে শুয়ে থাকতে চান। অথবা অন্ধকারে বাদুড়ের মতো শব্দের মধ্য দিয়ে পথ চিনে এগোতে চান। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে স্থবিরতা নয়, পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। জীবনে পরিবর্তন আছে ও ক্ষয় আছে। নির্বাণ লাভের পূর্ব পর্যন্ত পরিবর্তন হইতে মুক্তি নেই। তাই সবশেষে তিনি স্থবিরতাকে প্রশ্ন করিয়াছেন "স্থবিরতা তুমি আসিবে বলতো?"
বলাবাহুল্য, আকবর আলি খানের কাব্যবিশ্লেষণের অভিমুখ সরল। সরল বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে কি-না, কিংবা তাহা কৌতূহলী পাঠককে সন্তুষ্ট করিবে কিনা নিশ্চিত করিয়া বলা মুশকিল। আমাদের মনে হয় 'স্বপ্নের ধ্বনিরা' দীর্ঘতর বিশ্লেষণের দাবি রাখে কারণ জীবনানন্দ দাশের মৌল জীবনোপলব্ধির সহিত এই কবিতাটির গভীর সাযুজ্য রহিয়াছে।
'কুড়ি বছর পর' কবিতাটির চাবিকাঠি প্রসঙ্গে লেখা হইয়াছে: এই কবিতার নায়িকা এক কিশোরী যাহার নাম 'মনিয়া'। পূর্ণ যৌবন অর্জনের আগেই সে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে। কুড়ি বছর পর সে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতো। কবি এই কবিতায় ভাবছেন কুড়ি বছর পর মনিয়ার সঙ্গে দেখা হলে তার কী অনুভূতি হতো।
'হাওয়ার রাত' কবিতাটির চাবিকাঠি নিরূপণ প্রসঙ্গে খান সাহেব লিখিয়াছেন: কবিতাটির চাবিকাঠি হচ্ছে মশারি। তিনি মন্তব্য করিয়াছেন: পৃথিবীর সাহিত্যে মশারি সম্পর্কে এত অনুভূতি লইয়া আর কোন লেখা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। ─ জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন ডায়েরির খাতায় মশারী বিষয়ক বেশ কয়েকটি অনুষঙ্গ রহিয়াছে। এই রকম একটির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিরূপণ করিয়াছেন যে ইহা একটি প্রেমের কবিতা। এই প্রেমের নায়িকা কবির খুড়তুতো বোন শোভনা বা বেবি যাহাকে ডায়েরিতে জীবনানন্দ দাশ ওয়াই (Y) এবং, কখনও, বিওয়াই (BY) হিসেবে সংক্ষেপে উল্লেখ করিয়াছেন।
এই কবিতাটির আলোচনায় আকবর আলি খান সবশেষে লিখিয়াছেন: বিবাহিত জীবনে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা জীবনানন্দ'র পক্ষে সম্ভবপর নহে, কিন্তু বেবিকে ভুলিয়া যাওয়াও তাহার পক্ষে সম্ভব হইতেছে না। কবিহৃদয় নীল হাওয়ায় একটি দুরন্ত শকুনের মত 'স্বাতী' নক্ষত্রের কাছে ছুটিয়া যাইতে চায়। শকুন অশুভের প্রতীক। শকুনের আগে 'দুরন্ত' শব্দটি যোগ করিয়া কোন সন্দেহের অবকাশ কবি রাখেন নাই। কবি দুরন্ত শকুনের মতো স্বাতী নক্ষত্রের পানে ছুটিতেছেন ─ইহার সহজ অর্থ হইল জীবনানন্দ বুঝিয়াছেন যে বেবির জন্য তাহার প্রেম অশুভ। কিন্তু বেবির আকর্ষণও তিনি প্রতিরোধ করতে পারছেন না। বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের দৃশ্যের মধ্য দিয়া কবি প্রেমের অপ্রতিরোধ্যতা সম্পর্কে একটি সুসমঞ্জস বক্তব্য তুরিয়া ধরিয়াছেন।
''বনলতা সেন'' কাব্যগ্রন্থের ৩০টি কবিতার মধ্যে আকবর আলি খানের কাছে মনে হইয়াছে ১৮টি কবিতায় কোন চাবিকাঠি নেই। কবিতাগুলোকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করিয়াছেন যথা (ক) সাধারণ কবিতা, (খ) চাবিকাঠিসহ সাধারণ কবিতা, এবং (গ) দুরূহ কবিতা যার অর্থ উদ্ধারের জন্য চাবিকাঠি আবিষ্কার যথেষ্ট নয়। শেষোক্ত শ্রেণীর কবিতা হল 'হরিণেরা', 'বেড়াল', 'স্বপ্নের ধ্বনিরা' ইত্যাদি।
৪.
জীবনানন্দের দাশের কবিতা বিষয়ে আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া আকবর আলি খান বলিয়াছেন: আমি জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী হইয়া উঠি যখন দেখি তাহার অনেক কবিতা সহজে বোঝা যায় না। সাহিত্য-সমালোচকেরা এইসব 'দুর্বোধ্য' কবিতার ব্যাপারে কী লিখিয়াছেন তাহা জানিতে কৌতূহলী হইয়া উঠি এবং বিভিন্নজনের আলোচনা পড়িতে শুরু করি।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর সজনীকান্ত দাস বলিয়াছিলেন, জীবনানন্দের কবিতা সহজে অধিগম্য নহে; তাহার কবিতা উপলব্ধি করিতে হইলে কবিতার 'চাবিকাঠি' আবিষ্কার করিতে হইবে। ইহার পর হইতে জীবনানন্দের কবিতার বিশেষ বিশেষ শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে আমি চিন্তাভাবনা শুরু করি। যেমন 'হায় চিল' খুব বিখ্যাত একটি কবিতা। আমার মনে হইয়াছে এই কবিতাটি জনপ্রিয়;─ কিন্তু ইহার নিগূঢ় অর্থ সম্পর্কে কোনরূপ সচেতনতা নাই। আমি 'চিল' এবং নদীর নাম 'ধানসিঁড়ি' লইয়া চিন্তাভাবনা করিতে শুরু করি। আমার নিকট মনে হইয়াছে 'সোনালী ডানার পাখির কান্না'র তাৎপর্য বুঝিতে পারিলে তবেই এই কবিতার অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভবপর হইবে। আরও মনে হইয়াছে: অন্যান্য নদী বাদ দিয়া ধানসিড়ি নদীর কথা কবি কেন বলিয়াছেন তাহা জানিতে পারিলে কবিতাটির রসাস্বাদন সহজ হইবে। আমার মনে হয় 'সোনালী ডানার চিল' কথাটির তাৎপর্য হইল প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা।
খান সাহেব স্বীকার করেন যে জীবনানন্দের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু তাহার অভিমত এই যে বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের অনেক ক্ষতিও করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন: আমার কখনও কখনও মনে হযইয়াছে যে বুদ্ধদেব বসুর মত বন্ধু থাকিলে শত্রুর প্রয়োজন হইবে না। বুদ্ধদেব বসু মনে করিতেন জীবনানন্দ দাশের উপমা, চিত্রময়তা, ছন্দ ইত্যাদি কবিতার রস আস্বাদন করার জন্য যথেষ্ট, যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার মধ্যে কোন গভীর অর্থ নাই যাহা আদপেই ন্যায্য কোন কথা নহে।
আকবর আলি খান বলিয়াছেন: আমার মনে হয় কবিতার দুবোর্ধ্যতা কিংবা অস্পষ্টতা মানিয়া লইলে কবিতার অপব্যাখ্যা করা হয়। আবার অনেক সময় আপাত অর্থ মানিয়া লইলেও কবিতার নিহিতার্থ অধরা থাকিয়া যায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা কেবল উপমা বা চিত্রকল্পের কবিতা নহে। তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া লিখিয়াছেন। অনেক কবিতা আছে যাহা বুঝিতে হইলে ইহাদের চাবিকাঠিটি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে এবং তাহা লইয়া চিন্তা করিতে হইবে। আমি অনেকগুলো কবিতার চাবিকাঠি শনাক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি এবং তাহার মধ্য দিয়া কবিতার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দাঁড় করাইবার প্রয়াস পাইয়াছি। এই কাজটি সহজ হয় নাই, কারণ জীবনানন্দ দাশকে বুঝিতে হইলে বা তাহার কবিতাকে অনুধাবন করিতে হইলে তাহার মত করিয়া চিন্তা করিবার আবশ্যকতা রহিয়াছে।
তাহাকে বলা হইয়াছিল: 'জীবনানন্দ দাশের কবিতার চাবিকাঠি' বইটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার পশ্চাতে অন্যতম কারণ হইল বনলতা সেন কে ছিলেন ইহা লইয়া প্রদত্ব আপনার ব্যাখ্যা। তবে নাটোর শহরে বনলতা সেন নামে একজন গণিকা ছিলেন যাহার সহিত জীবনানন্দ দাশের সাক্ষাৎ হইয়াছিল─ এই ব্যাখ্যা অনেক পাঠক এবং সমালোচক গ্রহণ করেন নাই। এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
আকবর আলি খান বলিয়াছিলেন: বাংলা কবিতার সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী চরিত্র বনলতা সেনকে লইয়া পাঠকের কৌতূহলের কোন শেষ নেই। এই বনলতা সেন কে ─ সে কি বাস্তব কোনো নারী না সম্পূর্ণ কাল্পনিক এই প্রশ্ন লইয়া অনেক লেখালেখি হইয়াছে। জীবনানন্দ দাশ এই নারীকে নাটোরের বনলতা সেন হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। ২০১১ সালে আমি লিখিয়াছিলাম বনলতা সেন একজন গণিকার নাম হইতে পার। উহা একটি অনুমান মাত্র। ঐ অনুমানের ভিত্তি ছিল কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য। যে কোন অনুমান সত্য হইতে পারে, আবার ভুলও হইতে পারে। যাহারা বনলতা সেনের পরিচয় উদ্ঘাটনের চেষ্টা করিয়াছেন তাহারা নাটোর শব্দটি লইয়া তেমন মাথা ঘামান নাই। নিজে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করিবার সময়ও জীবনানন্দ দাশ বারবার Banalata Sen of Natore লিখিয়াছেন। তাই আমার কাছে মনে হইয়াছে নাটোর-এর উপরও গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। বনলতা সেন একজন গণিকা ছিলেন উহা প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে লেখার ফোকাস ঐদিকে সরিয়া গিয়েছিল। আমার ইচ্ছা পরবর্তী কোনো সংস্করণে এই ব্যাপারে আমি ব্যবস্থা নিব। বনলতা সেন-এর বাস্তব পরিচয় যাহাই হউক না কেন, সবকিছুর পর কবিতাটির সামগ্রিক তাৎপর্য অনুধাবন করাই কাঙ্ক্ষিত। তবে আমার মনে হয় ওরকম কিছু না লিখিলে মানুষ হয়ত বা বইটি তেমন পড়িত না।
Comments