আকবর আলি খান: বিদ্রোহী, স্বাধীন ও জনমুখী চিন্তক

২০০৬ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়ে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন সদ্যপ্রয়াত আকবর আলি খান। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হলে তিনিসহ অন্য ৩ উপদেষ্টা—হাসান মশহুদ চৌধুরী, সুলতানা কামাল ও সি এম শফি সামি একযোগে পদত্যাগ করেন।

২০০৬ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়ে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন সদ্যপ্রয়াত আকবর আলি খান। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হলে তিনিসহ অন্য ৩ উপদেষ্টা—হাসান মশহুদ চৌধুরী, সুলতানা কামাল ও সি এম শফি সামি একযোগে পদত্যাগ করেন।

আকবর আলি খান একজন 'সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ' মানুষ ছিলেন। তিনি তার পুরো জীবনটা ব্যয় করেছেন রাষ্ট্রকাজে। আমৃত্যু রাষ্ট্রধারণা বিকাশে কাজ করে যাওয়া এই পরিমিত মানুষটিই নানা সংকটে জাতিকে দিশা দিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে আসা এ মানুষটির স্পষ্টবাদিতা তাকে জনসাধারণের পছন্দের ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।

আজন্ম বিদ্রোহী এই মানুষটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হবিগঞ্জে পাকিস্তান সরকারের মহাকুমা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৬ মার্চের গণহত্যার পর তিনি নিজ দায়িত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করার জন্য গুদামঘর খুলে দেন।

এ ব্যাপারে অধুনালুপ্ত পত্রিকা 'সাপ্তাহিক'- এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আকবর আলি খান বলেছিলেন, '(মুজিবনগর) সরকার হওয়ার আগেও আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রশাসন চালিয়েছি। কারণ আপনি তো দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে পড়তে দিতে পারেন না। যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আসছে তখন আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কী হবে? তারা টাকা পাবে কোথায়, কী করবে? তখন কোনো সরকারি আদেশ ছাড়া আমি সকল সরকারি কর্মচারীকে তিন মাসের আগাম বেতন দিয়ে দেই। যেটা আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না।'

" layout="left"]

পরে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন আকবর আলি খান। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানি জান্তা তখন তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

দেশ স্বাধীন হলে আকবর আলি খান সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসর নেওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।

আকবর আলী খানকে কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে সীমিত রাখা কঠিন। অবসরের পর তার আবির্ভাব ঘটে পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য—বিচিত্র বিষয়ে তার গবেষণামূলক বই পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

একমাত্র কন্যার অকালমৃত্যুর পরও ভেঙে পড়েননি এই সাহসী মানুষটি। হুইল চেয়ারে বসে পড়েছেন। ক্রমাগত লিখে গেছেন। পক্ষাঘাতের জন্য জিভ আর ঠোঁট স্বভাবিক না থাকলেও তার ভাবনা ছিল পরিষ্কার।

মৃত্যুচিন্তা ও আত্মমূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি 'সাপ্তাহিক'-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করি। মৃত্যুর ওপর তো আমার কোনো হাত নেই। তবে মৃত্যু নিয়ে আমি ভয় করি না। ভয় করি না এজন্য যে, আমি আমার বিবেকের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কাজ করিনি। এজন্য আমি মনে করি আমাকে যখনই কোনো জবাবদিহিতার জন্য হাজির করা হবে আমার বিবেকের আলোকে যতটুকু সম্ভব সেটা হয়তো আমি ব্যাখ্যা করতে পারব।'

" layout="left"]

আকবর আলি খান ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। তার যেকোনো চর্চার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশ। জনমুখী উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বরাবর সজাগ। সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েও তিনি দেশের কাঠামোগত দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তার 'পরার্থপরতার অর্থনীতি' গ্রন্থে বলেছেন, 'নিজেদের দুর্নীতি হ্রাসে সরকারী কর্মচারিদের কোন আগ্রহ নেই; তাদের অনেকেই হচ্ছে দুর্নীতির প্রধান পোষক। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনেকেই দুর্নীতি দূর করতে চান। কিন্তু সরকারী কর্মচারিদের প্রতিরোধের সামনে তাঁরা অকার্যকর; অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দুর্নীতি দূর করতে তাই প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন।'

এই গ্রন্থের '"শুয়রের বাচ্চাদের" অর্থনীতি' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লেখেন, 'উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে: হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়রের বাচ্চাদের সামলান।'

শুরুতে আকবর আলি খান ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। পরে কাজ করেছেন অর্থনীতির নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। ফলে তার রচনায় অনেকগুলো শাস্ত্রকে এক করে নতুন একটা প্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আর এর সবকিছুর মধ্যেই ছিল জনস্বার্থ ও কল্যাণমুখী চেতনা।

আকবর আলি খানের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ 'পুরানো সেই দিনের কথা'। চলতি বছরের মার্চে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালীন দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি 'সামাজিক মুক্তি' নিয়ে এর দ্বিতীয় খণ্ড লেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, 'একটা জাতির স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু নাই। অর্থনৈতিক অগ্রগতিও আমাদের হয়েছে। আমরা তো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। গণতন্ত্র এখনো যদিও বাংলাদেশের সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুশাসন হয়নি। যেখানে আইনের শাসনও সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। সেখানে অনেক কিছু ভাবার আছে, দেখার আছে।'

আকবর আলি খান এখন সব ভাবনা-দর্শনের ঊর্ধ্বে। কিন্তু বিদ্যায়তনিক ও প্রশাসনিক পরিসরের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মননে যে জনস্বার্থ ও কল্যাণমুখী চেতনার ধারা তৈরি করে গেছেন তিনি, তা নিশ্চয় আগামী বাংলাদেশের পাথেয় হয়ে উঠবে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh per capita foreign debt 2024

Per capita foreign debt more than doubles in eight years

Per capita foreign debt of Bangladesh more than doubled in the last eight years, according to official data, as economists attribute the hike to unplanned foreign-funded projects and corruption, ultimately ballooning the liability on low-income people, including the extremely poor.

13h ago